• বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ইতিহাসে অনন্য: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা হস্ত‌ক্ষেপ করবে না: ওবায়দুল কাদের লালমনিরহাটে যুবলীগ কর্মীর পায়ের রগ কাটলেন যুবদল নেতা বাসার ছাদ থেকে পড়ে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু ঠাকুরগাঁওয়ে ঈদ-নববর্ষে ১০ জন নিহত, আহত ২ শতাধিক

সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন আইভি রহমান

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৪ আগস্ট ২০২১  

ড. মুহম্মদ মনিরুল হক   

হঠাৎ বিকট শব্দ! বিস্ফোরণ! একের পর এক গ্রেনেড নিক্ষেপ। যখন বিস্ফোরণের শব্দ থামল, তখন চারদিকে নিস্তব্ধতা। সবাই জ্ঞানশূন্য, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, দিশাহারা। ভয়, কান্না, আর্তচিৎকার, কাকুতি-মিনতির হাহাকার। কারো হাত, কারো পা, কারো নিথর-নিস্তব্ধ দেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে আছে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সমাবেশস্থল থেকে নিশ্চল-নীরব আইভি রহমানকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালেও তখন হতাহত মানুষ, লাশের সারি।

নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন, ‘আমার সামনে তখন লাশের স্তূপ, আম্মার কাছে যেতে হলে সেই লাশ ডিঙিয়ে যেতে হবে, উপায় নাই যাওয়ার কোনো। আমি তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, আম্মা, তুমি চিন্তা কইরো না, আমি চলে আসছি।’ জানি না কেন যেন আম্মা মাথাটা নাড়লেন, তখন বুঝলাম যে উনি বেঁচে আছেন। ...আম্মাকে যে একটু দেখবে, সার্জারি করবে, সে রকম একটা ডাক্তারও তখন নাই, সবাইকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দেখতে দেখতে প্রায় তিন ঘণ্টা চলে গেল। আমরা ঠিক করলাম, আম্মাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে। ...গেট দিয়ে বের হব, এমন সময় চারদিক থেকে পুলিশের বাধা, কোথাও নাকি যাওয়া যাবে না। ...ওরা বলল, ওপরের নির্দেশ, আমরা কোথাও যেতে দিতে পারব না! ...একটা পর্যায়ে তারা বলল, আম্মাকে শুধু সিএমএইচে আমরা নিয়ে যেতে পারব, আর কোথাও না। ...ক্যান্টনমেন্টের গেটে বসিয়ে রাখল এক ঘণ্টা, ঢুকতে দেবে না! সিএমএইচে যাওয়ার পর বলে, আর্মি অফিসারের রিকমেন্ডেশন লাগবে! আমার আম্মা ওখানে পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়, মানুষটা মারা যাচ্ছে, এ রকম অবস্থায় টানা ৮-৯ ঘণ্টা আমার আম্মাকে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয় নাই। ...২১ তারিখে গ্রেনেড হামলাটা হয়, ২৩ তারিখ রাত ১২টায় আমি সিএমএইচ থেকে বাসায় আসি। ...ঠিক রাত ২টার সময় আমাকে ফোন করা হলো, বলল, ...আপনার আম্মা তো মারা গেছেন! ...আমি বললাম, ...আমি আসছি। ফোনের ওপাশ থেকে বলল, এসে কোনো লাভ নাই, আমরা দাফন করে দিচ্ছি। ...ওপরের নির্দেশ, সব এখানেই করতে হবে! লাশ বাইরে নেওয়া যাবে না! ...এটা কিসের রাজনীতি রে ভাই?’

আইভি রহমান সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। হত্যা-সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যকে ঘৃণা করতেন। একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে এ দেশের মানুষ মেনে নেয়নি, তারা মেনে নেয়নি...ঘৃণিত খুনি উন্মুক্ত অস্ত্রধারী এবং তাদের পোষ্যদের উল্লাস।’ তিনি জন্মেছিলেন মেঘনা নদীর পারে। ১৯৪৪ সালের ৭ জুলাই ভৈরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর বাবা জালালউদ্দিন আহমেদ ছিলেন স্বনামধন্য শিক্ষক। আট বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে পঞ্চম আইভি বেড়ে উঠেছেন যৌথ পরিবারের শাসন-স্নেহে। তিনি ১৯৬০ সালে বাংলাবাজার স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৯ সালে ইডেন কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৮ সালের ২৭ জুন মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এর পর থেকে জিল্লুর রহমানের রাজনীতি, পরিবার, সংসার, ছেলে-মেয়ে সব কিছুর নিত্য সাথি হন আইভি রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তাঁদের বিয়ের অন্যতম উদ্যোক্তা ও প্রধান সাক্ষী। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে পারিবারিকভাবেও সম্পর্কিত ছিলেন আইভি রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার খালাশাশুড়ি।

আইভি রহমান ছাত্রাবস্থা থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও রেখেছেন ভূমিকা। তিনি বাংলাদেশে মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯৮০ সালে সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে প্রায় দুই যুগ তিনি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭৮ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক হন। রাজনীতির পাশাপাশি নারী ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজেও তিনি অবদান রেখেছেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি যথাক্রমে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধে ফার্স্ট এইড প্রশিক্ষণ নিয়ে অন্য নারীদের প্রশিক্ষণেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি আবার জয় বাংলা বেতারেও কাজ করেছেন। সমাজসেবায় অবদানের জন্য ২০০৯ সালে তাঁকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়।

আজীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিবিদ আইভি রহমান সন্ত্রাস-নৈরাজ্যহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছেন। বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে তাঁর পরিবারসহ তিনি শেখ হাসিনার পাশে থেকেছেন। জীবনের শেষবেলায়ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পাশে থেকে গুরুতর আহত হয়ে তিনি ২৪ আগস্ট ২০০৪ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন। জাতি আজও তা মেনে নিতে পারেনি। অকালে অন্যায়ভাবে ঘাতকরা তাঁর প্রাণ কেড়ে নিলেও তিনি অমরতার আসন লাভ করেছেন। আর কোনো সন্তান, আর কোনো সমাজকে যেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে হয়, সেই কামনা করি। রাজনীতিবিদ, লেখক, সমাজসেবক ও সোনার বাংলার কাণ্ডারি মহীয়সী আইভি রহমানকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
[email protected]

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –