• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে ক্রমবর্ধমান জলরাশি: গবেষণা উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে চার লেন চালু, ঈদযাত্রা হবে স্বস্তির সব উন্নয়ন সহযোগীদের এক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে: ভূমিমন্ত্রী বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা দিতে হবে: ওবায়দুল কাদের

বঙ্গবন্ধু হত্যার অসমাপ্ত বিচার

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট ২০২১  

মো. জাকির হোসেন   

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিচারিক আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ছয়জনের দণ্ড কার্যকর হয়েছে। কয়েকজন দণ্ড মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। পালিয়ে থাকা পাঁচজনের দণ্ড কার্যকর করতে সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই পাঁচজনের দণ্ড হয়তো সামনের দিনগুলোতে কার্যকর হবে। প্রশ্ন হলো, এর মাধ্যমেই কী বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সমাপ্ত হবে? আমার মূল্যায়নে অবশ্যই না। কিছু অপরাধের বিচারে আদালতের দণ্ডই যথেষ্ট হয় না। ইতিহাসের কাঠগড়ায় এর বিচার হতে হয়। মীরজাফরের বিচার কোনো আদালতে হয়নি। তবু মীরজাফর ইতিহাসে এক ঘৃণিত ব্যক্তি। মুর্শিদাবাদে মীরজাফরের ধ্বংসপ্রায় প্রাসাদে ঢোকার প্রধান ফটকটি ইতিহাসে, সরকারি দলিলে এবং ট্যুরিস্ট গাইড বইয়ে ‘নেমক হারাম দেউর’ বা ‘বিশ্বাসঘাতকের গেট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। কোনো বেঈমান বা বিশ্বাসঘাতককে গালি দিতে ব্যবহৃত হয় ‘মীরজাফর’ শব্দটি। বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশব্দ মীরজাফর একটি জঘন্য গালি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার আদালতের রায়ে সম্পূর্ণ হতে পারে না। আদালত বড়জোর ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করতে পারেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ত্যাগ, সাহসিকতা, অতল ভালোবাসা, দূরদর্শী নেতৃত্ব, অটল আদর্শ ও একবারের জন্য পাওয়া জীবনের সব ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুখ-স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তি মুজিবকে অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু হয়েছেন। বিশ্বের নিপীড়িত, মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও নিরন্তর অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু হয়েছেন। তিনি একটি জাতির জনক ও রাষ্ট্রের স্থপতি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কি কয়েকজন আত্মস্বীকৃত খুনিকে শাস্তি দিলেই সম্পন্ন হয়ে যায়? খুনিরা মধ্যম সারির সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। কয়েকজন সামরিক বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত ছিলেন।

যাঁর অঙ্গুলিহেলনে দেশের কোটি কোটি মানুষ জীবন দিতে সম্মোহিতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই প্রতাপশালী পরাশক্তির সমর্থন ও সাহায্যপুষ্ট পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন, জাতির সেই প্রাণভোমরাকে কয়েকজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা হত্যা করেছেন—এটি বিশ্বাসযোগ্য? কেউ খুন করেছেন, কেউ নেপথ্যে ষড়যন্ত্র করেছেন। কেউ পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধু, তাঁর সরকার ও পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কদাকার-কুৎসিত অপপ্রচার করে হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। কেউ পরিকল্পিতভাবে অরাজকতা সৃষ্টি করে ষড়যন্ত্র ও খুনের পরিবেশ তৈরি করে প্রভাবকের কাজ করেছেন। 

কেউ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। নেপথ্যের এসব কুশীলবের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। ইতিহাসের কাঠগড়ায় এসব বিশ্বাসঘাতকের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। অনাগত প্রজন্ম যাতে জানতে পারে কারা বাংলাদেশের বন্ধু আর কারা শত্রু? তারা যাতে জানতে পারে তাদের জাতির পিতার সঙ্গে কেমন অন্যায়-অবিচার করা হয়েছে। আর এ জন্য চাই যথাযথ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি তদন্ত কমিশন। তদন্ত কমিশনকে যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে নজর দিতে হবে, তা হলো—এক. খুনিদের কে বা কারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করেছে, মদদ জুগিয়েছে? হত্যাকাণ্ডে খুনিদের মদদদাতারা শুধু বাংলাদেশের নাগরিক, না অন্য কোনো দেশের সম্পৃক্ততা রয়েছে? পাকিস্তানের ভুট্টো ও যুক্তরাষ্ট্রের কিসিঞ্জার ও ফিলিপ চেরির সম্পৃক্ততার নানা তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। দুই. খুনিরা বা তাদের মদদদাতারা কী চেয়েছিল? অপবাদ দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্র হত্যা করেছিলেন। এই কথা কি সত্য? পুঁজি বা জমির মালিক উৎপাদনের প্রায় সবটুকু ভোগ করে। আর উচ্ছিষ্টভোগী শ্রমিক মারাত্মকভাবে বঞ্চিত হয়। এভাবে সমাজে সৃষ্টি হয় ভয়ানক বৈষম্য। বঙ্গবন্ধু এই বঞ্চনা ও বৈষম্য দূর করতে উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা তথা সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া শুধু রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন। 

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব দ্য ফিউচার অব ডেমোক্রেসির গবেষকরা সম্প্রতি বিশ্বের ১৫৪টি দেশের ওপর এক জরিপ করে জানিয়েছেন যে গণতন্ত্রের প্রতি অসন্তুষ্টি চরম পর্যায়ে। জরিপের ফলাফলে সতর্ক করে বলা হয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা এখন ‘উদ্বেগের’ পর্যায়ে রয়েছে। গবেষকরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি বা উচ্চমাত্রায় অসন্তুষ্টি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে। অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক ভেদাভেদে গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের অসন্তুষ্টি বেড়েছে। বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভেদাভেদের এই কুফল অনুধাবন করে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সম্মিলনে নতুন রাজনৈতিক দর্শনের পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন। নতুন যাত্রার শুরুতে সাময়িক সময়ের জন্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা তিনি নিজেই বলেছেন। কৃষক-শ্রমিক, গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় নতুন দর্শনের যাত্রায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণ যদি গণতন্ত্র হত্যা হয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? মোশতাক, বিচারপতি সায়েম ও জিয়া তিনজনই তো অসাংবিধানিক ও অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। 

বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ-সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন।’ এই তিনজনের কেউই সংবিধানের বিধান মেনে সংসদ সদস্যদের কর্তৃক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হননি। তদুপরি জিয়া একই সঙ্গে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কয়েক বছর সামরিক শাসন জারি ছিল। সামরিক শাসন বহাল থাকা অবস্থায় ‘হ্যাঁ, না’ ভোটের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। এটা কি গণতন্ত্র? তিন. বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণ হিসেবে কেউ বলছে, খুনিরা বাংলাদেশে ইসলামিক রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। ইসলামে বিচারের রায় ও যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া মানুষ হত্যার কোনো সুযোগ নেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লানত করবেন...।’ (সুরা নিসা : ৯৩) হাদিসে বর্ণিত হয়েছে : ‘দুনিয়া ধ্বংস করার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণ্যতর কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’ (তিরমিজি)। ইসলামে যুদ্ধক্ষেত্রেও নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করা নিষিদ্ধ।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহ) কোরআন ও হাদিসের বিধান লঙ্ঘন করে ইসলামী রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করা যায় কি? চার. খুনি ও তাদের দোসরদের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ ছিল না। তাদের মননে বাংলাদেশ নয়; ছিল পাকিস্তানের ছায়া। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে হত্যা করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। একীভূত করা সম্ভব না হলে কনফেডারেশন গঠন করে বাংলাদেশকে পকিস্তানের আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করা হত্যার উদ্দেশ্য ছিল। খুনিদের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষের প্রমাণিত মিত্রদের জন্য নিরাপত্তা ও রাজনীতির সুযোগ সৃষ্টি করা। 

আর তাই সামরিক ফরমান বলে সংবিধান সংশোধন করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়, দালাল আইনে দণ্ডিতদের ভোটার হওয়ার অযোগ্য ঘোষণাসংক্রান্ত সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে দালাল আইনে চলমান বিচার বন্ধ করা হয়। দালাল আইন রহিতকরণ করে ট্রাইব্যুনাল বাতিল করা হয়। মৃত্যুদণ্ডসহ নানা মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত ৭৫২ জন অপরাধীকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রী বানানো হয়। রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকা চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। এ সবই বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের আদলে গড়ার নীলনকশা। পাঁচ. সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা শুধু জাতির পিতা বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে আঘাত নয়, এ আঘাত প্রকৃতপক্ষে ছিল স্বাধীন ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে হত্যার চক্রান্ত। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৯৩ ডলার, সেটি সাড়ে তিন বছরে ১৯৭৫ সালে হয় ২৭৩ ডলার। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৭ শতাংশ। জাতিসংঘের তদানীন্তন আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ড. ভিক্টর এইচ উমব্রিখট মার্কিন সরকারের প্রতি খুনিদের আশ্রয় না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ১৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এক পত্রে লেখেন : গত ১২ মাস ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিরাট উন্নতি ঘটেছিল। ভালো খাদ্য পরিস্থিতি, বৃহত্তর খাদ্য মজুদ, ব্যাপক রপ্তানি ও ঘাটতিবিহীন বাজেটও ছিল। ছিল জনহিতকর কর্মসূচি, অপেক্ষাকৃত জনবান্ধব প্রশাসন প্রভৃতি। 

কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্তম অংশটিকে কেন নির্মূল করা হলো, তা উপলব্ধি করা দুরূহ। ছয়. বাংলাদেশের সংবিধানের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি অবস্থান। শুধু তা-ই নয়, সংবিধানে এর সংযোজন সারা বিশ্বেই একটি অনন্য উদাহরণ। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র শুধু সংবিধানেই অন্তর্ভুক্ত করেননি, বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি সমাজতন্ত্রের কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেন। শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করেন। জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পদে ৪০ শতাংশ শ্রমিকের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ১৯ মে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপের জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের জনগণকে বাঁচাতে হলে সমাজতন্ত্র ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।’ বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন, ‘আমি মার্ক্সিস্ট নই। আমি একজন সমাজতান্ত্রিক, কিন্তু সেটা আমার নিজস্ব পথে।’ তবে তিনি বিশ্বাস করতেন, যে সমাজতন্ত্র জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেটা সত্যিকারের সমাজতন্ত্র হতে পারে না। মানুষের মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, বিকাশ লাভ করে, সেই সমাজতন্ত্রই প্রকৃত সমাজতন্ত্র।’ 

তার পরও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে দেশে কেন অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল? পাঁচজন সংসদ সদস্যসহ অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়, ঈদের জামাতে হামলা করা হয়, পাটের গুদামে আগুন দেওয়া হয়, থানা আক্রমণ করা হয়, রেললাইন তুলে ফেলা হয়। যুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া রাষ্ট্র যখন সবাই মিলে মেরামত করার কথা তখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে অরাজকতার পেছনে কী কারণ ছিল তা অনুসন্ধানের দাবি রাখে। সাত. বঙ্গবন্ধু, তাঁঁর সরকার ও পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বানোয়াট কাহিনি, কদাকার মিথ্যা অপপ্রচার কারা করেছে তা অনুসন্ধান করা জরুরি। আট. বঙ্গবন্ধুর সরকারের ব্যর্থ খাদ্যসচিব আবদুল মোমেন খান জিয়া সরকারের খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। কৃত্রিম খাদ্যসংকট সৃষ্টিতে মোমেন খান ও তার দোসরদের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার। নয়. বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পরিকল্পনার খবর কেন আগে জানা সম্ভব হয়নি এবং বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে সাহায্য চাইলেও কেন সেনাবাহিনীর অন্য কোনো ইউনিট এগিয়ে আসেনি সেটি আজও এক বিরাট প্রশ্ন। দশ. সেনাবাহিনীর মধ্যম সারির কয়েকজন কর্মকর্তার নৃশংস অপরাধের বিচার করতে তদানীন্তন সেনাবাহিনী কেন ব্যর্থ হয়েছিল? সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব.) তাহেরসহ অনেকের বিচার করা সম্ভব হলো। তাহেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো, অথচ একই সেনাবাহিনীর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার কেন সম্ভব হলো না? প্রয়োজনে যুদ্ধ করে হলেও খুনিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে তারা জেলহত্যার সুযোগ পেত না। খুনি ও তাদের দোসরদের না থামানোর ফলে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের যে ভয়ংকর ক্ষতি হয়েছে ৪৬ বছর ধরে তার কুফল ভোগ করছে রাষ্ট্র। 

শুধু যে স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে তা নয়, মুক্তিযুদ্ধের লেবাস পরে এমন রাজনীতির অভ্যুদয় হয়েছে যে রাজনীতিতে রাষ্ট্রের স্থপতিকে অস্বীকার করে তাঁর নামনিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে, জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, রাষ্ট্রের চরিত্রকে পাল্টে দেওয়ার অপচেষ্টা করেছে, সর্বোপরি রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েছে। এই অপচেষ্টা এখনো থেমে নেই।

একটি কমিশন গঠন করে হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচন করে তাদের ইতিহাসের কাঠগড়ায় জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথে সব ষড়যন্ত্র, হুমকি, বাধাবিপত্তি দূর করতে বাংলাদেশের শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে হবে। তাহলেই শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যার অসম্পূর্ণ বিচার সম্পূর্ণ হবে। কিছুটা হলেও পিতৃহত্যার দায়মুক্তি হবে বাঙালি জাতির।

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –