• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

কোরআনের ভাষায় মানবজীবনে বৃষ্টি

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৪ জুলাই ২০২১  

বৃষ্টি আল্লাহর বিস্ময়কর অনুগ্রহের নাম। বৃষ্টিশূন্য খরার ভেতর দিন যাপন করতে বাধ্য মানুষগুলোই এ কথা হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে পারে। দিনের পর দিন তারা সুবিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে; কয়েক ফোঁটা শীতল রহমতের জন্য কায়মনোবাক্যে আকুতি জানায়। এক পশলা বৃষ্টি ধূসর-নিষ্প্রাণ মরুর বুকেও জাগিয়ে তুলতে পারে প্রাণের ছোঁয়া; দাবানলে পোড়া শস্যক্ষেত এবং উজাড় হওয়া বনে আনতে পারে সবুজের সমারোহ। বৃষ্টির এই জীবন-জাগানো প্রকৃতির সঙ্গে কোরআনের রয়েছে গভীর যোগসূত্র। মানুষের ঘুমন্ত হৃদয়কে জাগাতে এবং মরচে ধরা নিষ্প্রাণ অন্তরকে সুশোভিত করতেই আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন। গুনাহর দাবদাহে ফেটে চৌচির হৃদয়ের জমিতে সবুজ ফসল ফলাতে কোরআনই এক পশলা স্বস্তির বৃষ্টি।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বিভিন্নভাবে বৃষ্টির প্রসঙ্গ এনেছেন। পৃথিবীর জীবন-চঞ্চলতা ও অস্তিত্ব রক্ষায় এটি এক অনিবার্য উপাদান। বৃষ্টি, পানি ও সাগর-নদীর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ একমাত্র আল্লাহরই হাতে। তিনি সেই নিয়ামতের কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে তোমাদের জীবিকার জন্য বিভিন্ন ধরনের ফলমূল উৎপন্ন করেন।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত ৩২)

শুধু বৃষ্টিই নয়, সাগর থেকে বৃষ্টিসঞ্চারী মেঘমালা আকাশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া এবং বর্ষণের পর ফের তা মানুষের কল্যাণে সংরক্ষণ করে রাখার ক্ষমতাও তাঁরই হাতে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি বৃষ্টিসঞ্চারী বায়ু পাঠাই। এরপর আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি আর তোমাদের পান করাই। মূলত তোমরা তা সংরক্ষণ করতে সক্ষম নও।’ (সুরা : হিজর, আয়াত ২২)

পৃথিবীতে এমন অনেক বিস্তীর্ণ অঞ্চল রয়েছে, যাতে প্রাণধারণ অনেকাংশেই অসম্ভব; সবুজ-শ্যামল পৃথিবী আর ভেজা মাটির ঘ্রাণ সেখানে স্বপ্নের চেয়ে বেশি কিছু নয়। তবে সেই ঊষর মরুর বুকে যখন রহমতের বৃষ্টি নেমে আসে, তখন রুক্ষ মাটির কোষে কোষে প্রাণের সঞ্চার হয় এবং মাটি ভেদ করে বেরিয়ে আসে সবুজাভ বৃক্ষ-লতা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যিনি আকাশ থেকে পরিমিত বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এরপর তা দিয়ে আমি মৃত ভূ-ভাগ সঞ্জীবিত করি। এভাবেই তোমাদের পুনরুত্থিত করা হবে।’ (সুরা : যুখরুফ, আয়াত ১১)

পাখির চঞ্চু থেকে পড়ে যাওয়া শস্যদানাটিও একটু বৃষ্টির ছোঁয়া কিংবা হালকা আর্দ্রতা পেলে তরতরিয়ে বেড়ে ওঠে এবং দুই হাত ভরে আমাদের দান করে। যত রকমারি শাক-সবজি ও বাহারি ফলফলাদি আমরা খাই, সবই বৃষ্টির দান। আর বৃষ্টি, সে তো মহান আল্লাহর দান! ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর তিনিই আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এরপর তা দিয়ে আমি সব ধরনের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি। এরপর তা থেকে সবুজ পাতা গজিয়ে দিই—তা থেকে বের করি ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা। আর খেজুরগাছের মাথি থেকে বের করি ঝুলন্ত থোকা, সৃষ্টি করি আঙুরের বাগান, জয়তুন ও ডালিম—একই রকম, আবার রকমারিও। গাছে যখন ফল আসে এবং তা পাকে, তখন তাকে গভীর দৃষ্টি দাও। এসবে মুমিনদের জন্য রয়েছে অনেক নিদর্শন।’ (সুরা : আনআম, আয়াত ৯৯)

একইভাবে মানবহৃদয়ের বৃষ্টি হলো পবিত্র কোরআন। বৃষ্টি যেমন মাটি নরম করে পৃথিবী সাজায়, কোরআনও মানুষের হৃদয় নরম করে আলোকিত জীবন গড়তে সাহায্য করে। ঘুমন্ত বিবেক, মৃত আত্মা এবং গুনাহ ভরা পাথর-কঠিন মন ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে কোরআনের পরশেই। তাইতো বৃষ্টির সঙ্গে মানবহৃদয়কে তুলনা করে আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের জন্য কি সময় আসেনি যে আল্লাহর স্মরণ এবং যে সত্য (কোরআন) নাজিল হয়েছে তার মাধ্যমে তাদের হৃদয়গুলো নরম হবে? আর তারা তাদের মতো যেন না হয়, যাদের ইতিপূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল, এরপর বহুকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেলে তাদের হৃদয় কঠিন হয়ে যায়। তাদের বেশির ভাগ ছিল পাপাচারী। জেনে রেখো, আল্লাহ ভূ-ভাগকে মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত করেন। আমি তোমাদের জন্য আমার নিদর্শনগুলো খুলে বলেছি যেন তোমরা বুঝতে পারো।’ (সুরা : হাদিস, আয়াত ১৬-১৭)

মুমিনের হৃদয়কে জমি এবং কোরআনকে বৃষ্টি হিসেবে কল্পনা করুন। কোরআনের শীতল বৃষ্টি যখন রুক্ষ বুকের জমিতে পড়ে, তখন তা ইমামের বলে বলীয়ান এবং প্রবল আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। এরপর জীবনের অন্তিম লক্ষ্য জান্নাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ছুটে চলে অবিরাম।

তবে বৃষ্টি যেমন তার ছোঁয়ায় ভিন্ন ভিন্ন জাতের বৃক্ষ উৎপন্ন করে, তেমনি কোরআনও মানুষের হৃদয়কে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করে গড়ে তোলে। আপনি দেখবেন, প্রত্যেক বিশ্বাসী মানুষের আলাদা ব্যক্তিত্ব, গুণ, অভিজ্ঞতা, আদর্শ, ভালোবাসা ও ঘৃণার জায়গা রয়েছে। তবে মত-পথের ভিন্নতা সত্ত্বেও মুমিনের গন্তব্য একটিই—জান্নাত। এ যেন সবাই একই বৃষ্টির ফসল!

বিশ্বাসী প্রাণে মতভিন্নতা থাকবেই—এটিই বিশ্বাসের সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা। কে কোন ভালো কাজের মাধ্যমে অনন্ত সাফল্যের অধিকারী হবে, তা আমরা কেউই জানি না। কোনো সৎকাজই পরকালের পরীক্ষায় উতরে যেতে যথেষ্ট নয়—যদি হৃদয়টা আল্লাহর ভয়ে বিগলিত এবং কোরআনের সত্যগ্রহণে উন্মুখ না হয়। হৃদয় যত সজীব, বলিষ্ঠ এবং কোরআনের রঙে রঙিন হবে, তত তা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সহায়ক হবে।

বৃষ্টির ছোঁয়ায় উৎপন্ন হাজারো কিসিমের বৃক্ষের সহাবস্থান যেমন আমরা মেনে নিই, তেমনি বিশ্বাসী হৃদয়ের বিচিত্রতাও আমাদের সাদরে গ্রহণ করতে হবে। হাজারো ভিন্ন জাতের বৃক্ষের সমন্বয়ে যেমন সুবিশাল আমাজন বন গড়ে উঠেছে, তেমনি কোটি জীবন্ত প্রাণের বন্ধনে গড়ে উঠবে শক্তিশালী মানবসমাজ। কারণ নিজের মতের ওপর পুরো পৃথিবী গড়ে তোলা আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো, কোরআনের বৃষ্টিতে আমাদের ও চারপাশের হৃদয়গুলো আর্দ্র করা, মতবৈচিত্র্য মেনে নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুসংহতভাবে বসবাস করা এবং সুন্দর-সহিষ্ণু পৃথিবী গড়ে তোলা।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –