• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
ইসরায়েলের হামলার পর প্রধান দুটি বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল শুরু। ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানে।

রমজানের শিক্ষা জারি থাকুক বছরজুড়ে

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৬ মে ২০২২  

রমজানের শিক্ষা জারি থাকুক বছরজুড়ে                          
রমজান মুমিন ব্যক্তিদের জীবনে পরম প্রাপ্তি। এটি মহান আল্লাহর মহা দান। রহমত–বরকতে পরিপূর্ণ রমজান মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রজুড়ে প্রভাব বিস্তার করে আছে। রমজান ঈমানের পরিপূরক, রমজান তাকওয়ার সহায়ক, রমজান বেহেশতের সওগাত।

রমজানের রোজা মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে চলার শিক্ষা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও আত্ম-অহংবোধ ভুলে গিয়ে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাসই হলো মাহে রমজান। উম্মতে মুহাম্মদীর নৈতিক চরিত্র উন্নত করে সাহাবায়ে কিরামের মতো আদর্শ জীবন গঠন করার প্রশিক্ষণ এ মাসেই গ্রহণ করতে হয়। ইসলামের প্রতিটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রমজানের সঙ্গে সম্পর্কিত; তাই রমজানের শিক্ষা জীবনঘনিষ্ঠ ও জীবনব্যাপী।
 
ঈমান ও রমজান: ঈমান হলো ইসলামের প্রাণশক্তি। ঈমানের ভিত্তি হলো ওহি। ওহি তথা সব আসমানি কিতাবগুলো অবতীর্ণ হয়েছে রমজান মাসে। কোরআন ম​জিদও রমজান মাসে শবে কদরে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই রমজানের সঙ্গে ঈমানের সুদৃঢ় যোগসূত্র বিদ্যমান। ঈমান যেমন মানুষকে কুফর ও শিরক থেকে মুক্ত করে; তেমনি রমজান মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করে।

নামাজ ও রমজান: ঈমানের পরেই হলো নামাজ। রমজান মাস হলো নামাজের মাস। যেমন: তারাবি বা প্রশান্তির বিশ্রামের নামাজ। রাত জাগরণের নামাজের পাশাপাশি রমজানে সাহরির বদৌলতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া সহজ হয়; এশার নামাজ ও ফজরের নামাজ জামাতে পড়ার সুযোগ বৃদ্ধি হয়, যাতে পূর্ণ রাত জাগরণের সওয়াব অর্জন হয়।

ফজরের নামাজ আগেভাগে পড়ে ঘুমানোর কারণে সকালে ইশরাক নামাজ পড়ার সুবিধা হয়। বিকেলে কর্মক্ষেত্র থেকে আগে বাড়ি ফেরার সুবাদে আসর নামাজ জামাতে পড়া যায়। ইফতার উপলক্ষে মাগরিবের নামাজ জামাতে পড়া যায়। অন্যান্য নফল নামাজও বেশি পড়া হয়।

রোজা ইসলামের অন্যতম খুঁটি। রোজা হলো রমজানের সেরা অনুষঙ্গ। আগুন যেমন স্বর্ণকে নিখাদ করে দেয়; রোজা তেমনি ইমানদারের ষড়রিপুর কামনা–বাসনাকে জ্বাালিয়ে–পুড়িয়ে তাকে খাঁটি বান্দায় পরিণত করে। তাই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজার জন্য রমজান মাসকেই নির্ধারণ করেছেন।

জাকাত ও রমজানের সম্পর্ক: ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হলো জাকাত। রমজানের সঙ্গে জাকাতেরও সুনিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। জাকাত মানে যেমন পবিত্রতা, তেমনি রমজান মানে হলো আগুনে পুড়ে সোনা খাদমুক্ত বা খাঁটি করা। জাকাত মানে প্রবৃদ্ধি আর রমজানে প্রতি ইবাদতের সওয়াব আল্লাহ ৭০ গুণ বৃদ্ধি করে দেন।

ফিদইয়া ও রমজান: রমজানের মাহাত্ম্যের আরেকটি হলো ফিদইয়া। রমজানের রোজা একটি শারীরিক ইবাদত। কিন্তু অক্ষম ও দুর্বল ব্যক্তির জন্য এর কাজার পাশাপাশি ফিদইয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে; যা আর্থিক ইবাদত। এতে রোজার পরিধির ব্যাপকতা বোঝা যায়

আদর্শিক পরিবর্তনে রমজান
রোজা মুসলমানদের আদর্শ চরিত্র গঠন, নিয়মানুবর্তিতা ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের শিক্ষা দেয়। সত্যিকার মুমিন হিসেবে গড়ে ওঠার অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাস এ রমজানুল মোবারক; এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সব প্রকার নাফরমানি কাজ থেকে দূরে থাকার নামই ‘তাকওয়া’। রোজা বান্দার মনে আল্লাহর ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে থাকে। আল্লাহর কাছে বান্দার মান-মর্যাদা নির্ধারণের একমাত্র উপায় তাকওয়া। এটিই মানুষের মনে সৎ ও মানবিক গুণাবলি সৃষ্টি করে।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘ওহে যারা ঈমানের ঘোষণা দিচ্ছ (শোনো) তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো। যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, উদ্দেশ্য এই যে, তোমরা যেন তাকওয়ার শিক্ষা লাভ করতে পার। তবে তোমাদের যারা রুগ্ন কিংবা সফরের অবস্থায় থাকবে তাদের জন্য পরবর্তী সময়ে এ সংখ্যা পূর্ণ করে দেয়ার অবকাশ থাকল। আর যাদের রোজা দৈহিক সামর্থ্য নিঃশেষিত প্রায় হয়ে এসেছে তাদের জন্য প্রতি রোজার বিনিময়ে একজন মিসকীনের খাবার দানের ব্যবস্থা রাখা হলো। তবে কেউ অতিরিক্ত কিছু কল্যাণকর্ম সম্পাদন করলে তা হবে তার পক্ষে উপকারী আর তোমরা রোজা রাখতে পারলেই তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমরা জানতে পার। রমজান মাস হলো এমন একটি সময় যার মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছে কুরআনুল কারীম। মানবগোষ্ঠীকে হেদায়েতের সন্ধ্যান দানের উদ্দেশ্য আর যা নাকি হেদায়েতের সুস্পষ্ট নির্দেশনাবলি এবং সত্য ও মিথ্যা পার্থক্য বিধায়ক। অত্রএব, তোমাদের যে কেউ রমজান মাসটি প্রাপ্ত হবে সে যেন তাতে অবশ্যই রোজা রাখে।’ (আল-বাকারা : ১৮৩-১৮৫)

রমজানে ইবাদতের পাশাপাশি মানবিক কিছু বিষয়ের শিক্ষা অর্জন করাও আবশ্যক। অভুক্ত-অনাহারে থেকে একধরনের সাধনা করা হলো রোজার মৌলিক প্রতিপাদ্য। ক্ষুধার্ত মানুষ বছরের ১২টা মাস কীভাবে কাটায় রোজা আমাদের মাঝে সে উপলব্ধি জাগ্রত করে। বিশ্বব্যাপী মানুষ নিজের সুখ, নিজের সমৃদ্ধি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যক্তিকে করে তুলেছে আত্মস্বার্থনির্ভর দ্বিপদবিশিষ্ট এক অদ্ভুদ প্রাণি হিসেবে।

রোজা এ ধরণের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে অনাহারি অভুক্ত মানুষের কথা ভাবতে শেখায়। পৃথিবীর দেশে দেশে ক্ষুধা, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের প্রতিচ্ছবি রোজাদারের সামনে ভেসে ওঠে। রোজাদার উপলব্ধি করতে পারে মানব সন্তানের কষ্টময় জীবন। এ উপলব্ধি তাকে সকলকে নিয়ে সুখি হয়ে বাঁচতে শেখায়।

রমজানে কর্মচারিদের কষ্টের বোঝা হালকা করার নির্দেশ এসেছে। শ্রমিকদের প্রতি দয়াপরবশ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ইসলামে শ্রমিকের অধিকার অসামান্য। তার শ্রমঘণ্টা, শ্রমমূল্য, সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার ইসলামে সুন্দরতম উপায়ে সংরক্ষিত। তদুপরি মাহে রমজানে শ্রমিকের কষ্ট হালকা করার নির্দেষ দিয়ে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এ মাসে তার গোলাম তথা কর্মচারিদের কাজের বোঝা কমিয়ে দেয় আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন। হাদিসে আছে, ‘রোজাদারকে ইফতার করালে রোজাদারের সমপরিমাণ সাওয়াব অর্জন করবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-১৭০৭৪) 

নবীজি মানুষকে আহার করানোর জন্য এভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন। মন ভরে ইফতার বিলাতে হবে। রোজাদারকে ইফতার করানোর মধ্য দিয়ে মানুষকে আহার করানোর একটি মানসিকতা তৈরি করতে হবে। পরিচিত-অপরিচিত সবার প্রতি সমান ভালোবাসা নিয়ে ইফতার বিলাতে হবে। অপরের পাশে দাঁড়ানোর এই মূল্যবান মানসিকতার মধ্য দিয়ে আভিজাত্যের একটা চর্চা নিজেদের জীবনে সৃষ্টি করতে হবে। বছরের বাকি দিনগুলোতেও সৃষ্টির প্রতি যথাযথ বদান্যতা প্রদর্শন করতে হবে। এগুলোই রমজান শিখিয়ে যায়।

মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা একটি ইবাদত। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম সে যার আচরণ ভালো, যার চরিত্র সুন্দর’। রমজান মাসে মানুষের প্রতি সুন্দর আচরণের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নবীজি বলেছেন, ‘যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় কিংবা তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে তাহলে তুমি বল যে আমি রোজাদার।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৮৯৪)

রমজান সহযোগিতা সহমর্মিতার মাস। এ সহযোগিতা কোনো দেশ কাল পাত্র কিংবা কোনো আদর্শ ও দর্শনের সঙ্গে সীমিত নয়। স্রষ্টার প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি সহযোগিতা সহমর্মিতার শিক্ষা রমজান আমাদের দিয়ে যায়। রমজানে ইবাদতের অনেক ফজিলত রয়েছে। ফজিলতপূর্ণ ইবাদতের পাশাপাশি আমরা কিছু মানবিক দিকের কথা তুলে ধরেছি। এগুলোও ইবাদত। এই মানবীয় গুণাবলিগুলো অর্জন করার মধ্য দিয়ে যাবতীয় ইবাদত পূর্ণতা পাবে। রোজার প্রকৃত শিক্ষা ও তাৎপর্য অন্তরে ধারণ করতে হলে এই গুণাবলিগুলোর আলোকে নিজের জীবন সাজাতে হবে। মানবিকতা, পরোপকারিতা, উদারতা, দানশীলতা অপরের কল্যাণ কামনা রোজার প্রকৃত শিক্ষা। এসব শিক্ষার আলোকে ব্যক্তির যাপিত জীবন সাজিয়ে একটি আলোকিত রাষ্ট্র এবং সুন্দর পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে উৎসর্গিত হোক প্রতিটি মানুষের সিয়াম সাধনা।

রমজানে মুমিন বান্দাদের মধ্যে দান-খয়রাতের আগ্রহ বেড়ে যায়। এটিও আল্লাহর অনুগ্রহ। সম্পদের মালিক আল্লাহ। বান্দা নিছক আমানতদার। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সম্পদ ব্যয় করা মুমিনের কর্তব্য। ধনীর সম্পদে অভাবী ও বঞ্চিতদের প্রাপ্য রয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে কুরআন মাজিদে। রমজানে মুমিন বান্দারা আল্লাহর এ বিশেষ হুকুম পালনে আরো আগ্রহী হয় অন্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি সওয়াব লাভের আশায়। এ কারণেই রমজান মাসে জাকাত আদায়ের রেওয়াজ চালু হয়েছে। তা ছাড়া সদকাতুল ফিতর এ মাসের সাথে জড়িত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কখনো সম্পদ জমা থাকত না। এ জন্য তার ওপর কখনো জাকাত ফরজ হয়নি। সদকাতুল ফিতর ওয়জিব হওয়ার মতো সম্পদও তার কাছে থাকেনি; কিন্তু তিনি সব সময় দানের হাত সম্প্রসারিত রাখতেন। আর রমজান এলে তার দানের মাত্রা অত্যন্ত বেড়ে যেত বলে সাহাবায়ে কেরাম বর্ণনা করেছেন। অতএব রমজান শেষ হলেও এসব ইবাদত অব্যাহত রাখা উচিত।

রমজানের শিক্ষা ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
প্রতি বছর আমাদের দোয়ারে রমজান আগমন করে তাকওয়ার উৎকর্ষে মুমিনকে পূর্ণতা দিতে। মাসব্যাপী রোজা, তারাবি, ইফতার, সাহরি, তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত ও ইতিকাফের মাধ্যমে আমরা যে সংযম, লোভ সংবরণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ নিয়েছি; তা বাকি ১১ মাস কাজে লাগাতে হবে। যেমন রমজানে আমরা রোজা অবস্থায় হালাল খাবারও গ্রহণ করিনি, অনুরূপ রমজানের বাইরে আমরা হারাম খাদ্য, হারাম সম্পদ, হারাম উপার্জন পরিহার করব; অবৈধ সম্ভোগ থেকে বিরত থাকব। সব ধরনের অন্যায় অপরাধ ও হারাম কাজ থেকে দূরে থাকব; বেশি বেশি নেক আমল করার চেষ্টা করব; তবেই আমাদের রমজানের প্রশিক্ষণ যথার্থ ও সফল হয়েছে বলে মনে করা যাবে।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –