• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে ক্রমবর্ধমান জলরাশি: গবেষণা উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে চার লেন চালু, ঈদযাত্রা হবে স্বস্তির সব উন্নয়ন সহযোগীদের এক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে: ভূমিমন্ত্রী বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা দিতে হবে: ওবায়দুল কাদের

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৯ আগস্ট ২০২১  

জয়ন্ত ঘোষাল

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন সম্প্রতি দিল্লি সফর করে গেলেন। বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাঁর এই সফর তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল—সবার সঙ্গেই তিনি সবিস্তার আলোচনা করেছেন। কোয়াড থেকে আফগানিস্তান, ইন্দোপ্যাসিফিক ঘটনাবলি এবং সর্বোপরি বাইডেন কিভাবে এক ‘প্রযুক্তিনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি’র পথে চলেছেন, সেটাই ছিল এবারের সফরের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা।

এমন একটা সময় অ্যান্টনি ব্লিংকেন ভারতে এলেন, যখন ৩১ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সেনা প্রত্যাহার করার কথা। সেই সুযোগে তালেবানরা ক্রমেই কাবুলের দিকে এগোচ্ছে এবং কাবুল প্রশাসন দখল করল বলে এ রকম একটা পরিস্থিতি! আমেরিকার আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে যতটা লোকসান, তার চেয়ে এই মুহূর্তে অনেক বেশি শঙ্কা ভারতের। নরেন্দ্র মোদি চিরকাল সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনা তো দূরের কথা, দমননীতি নিতে চেয়েছেন; তা সে কাশ্মীরেই হোক আর আফগানিস্তানে। সেই তালেবানের সঙ্গে কথা বলতে যেতে হচ্ছে মোদি সরকারকে। অজিত ডোভাল তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করে একটা ‘তালেবানি সরকার’ গঠনের ব্যাপারে মতামত দিচ্ছেন।

পারভেজ মোশাররফের সময় ‘ভালো তালেবান’ আর ‘খারাপ তালেবান’-এর তফাত করার একটা কূটনীতি দেখা দিয়েছিল। তারপর দীর্ঘদিন কেটে গেছে। বিন লাদেন হত্যার পর আল-কায়েদার ভূমিকা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে আমেরিকা। আজ হঠাৎ আমেরিকা সেনা তুলে নেওয়ার পর আবার আফগানিস্তানে তালেবানীকরণ হচ্ছে এবং পাকিস্তান সেই প্রক্রিয়ায় মদদ দিচ্ছে। প্রথম দিকে আশঙ্কা থাকলেও এখন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও তালেবানের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করে ফেলেছেন।

আফগানিস্তানে ভারতের দীর্ঘদিনের নিয়ন্ত্রণ। এমনকি আফগানিস্তানের সংসদ ভবন পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ভারত তা নির্মাণ করেছে। কারজাইয়ের সময় মনে পড়ে তিনি ঘন ঘন অটল বিহারি বাজপেয়ি এবং লালকৃষ্ণ আদভানির সঙ্গে দেখা করতেন। আর এত বেশি আসতেন যে একবার আদভানি কারজাইয়ের জ্যাকেট দেখে খুব প্রশংসা করায় কারজাই খুশি হয়ে কাবুল থেকে জ্যাকেটের কাপড় এনে ঠিক একই রকম ডিজাইনের জ্যাকেট তৈরি করে উপহার দিয়েছিলেন আদভানিকে। আদভানির জ্যাকেটের মাপ নেওয়ার জন্য কারজাই একজন দরজিকেও তাঁর সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।

এই ভারত ও আফগানিস্তানের যে সখ্য, সেটির আজ কী হবে? কারজাই একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আছেন এবং ইমরান খানও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ইমরান খান তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন একটা প্রতিনিধিদল নিয়ে পাকিস্তানে আসার জন্য। ভারত গোটা ব্যাপারটা দেখছে; কিন্তু ঠিক কোন পথে যাবে সেটা বুঝতে পারছে না। কারণ আজ আমেরিকার সঙ্গেও সুসম্পর্ক রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি বলে মনে করছে ভারত। তার মধ্যে একটা মস্ত বড় ভূমিকা নিচ্ছে চীন।

বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে আলোচনা সেখানে আমেরিকা বারবার মোদি প্রশাসনকে বোঝাতে চাইছে যে আফগানিস্তান শুধু নয়, ইরাক থেকেও আমেরিকা সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। অর্থাৎ বাইডেন একটা নতুন নীতি নিতে চলেছেন, সেখানে এই মুহূর্তে আফগানিস্তান বা ইরাক কিন্তু আমেরিকার কাছে অগ্রাধিকার নয়। তার বদলে বাইডেন গুরুত্ব দিচ্ছেন চীনকে। চীনের সঙ্গে এক নতুন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে আমেরিকা। এই লড়াইটা ঠিক ট্রাম্পের কায়দায় নয়। ট্রাম্প যে রকম রাত জেগে টুইট করতেন, চীনের সঙ্গে কার্যত একটা নিরাপত্তাজনিত সংঘাতের পথে চলে যাচ্ছিলেন। এমনকি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একটা প্রবল বিবাদের পথে তিনি গিয়েছিলেন। তাতে মনে হচ্ছিল যেন একটা যুদ্ধই প্রায় লেগে যেতে পারে!

বাইডেন কিন্তু সে পথে না গিয়ে বাইডেনের যে নয়া চীননীতি, সেখানে তিনিও চীন সম্পর্কে ট্রাম্পের যে নীতি অর্থাৎ সংঘাতের পথে আমেরিকাকে যেতে হবে, সে পথেই তিনি আছেন। এমন নয় যে ‘রিপাবলিকান’-এর পর ‘ডেমোক্রেটিক’ দলের নেতা হয়ে গিয়ে তিনি চীনের সঙ্গে প্রেম নিবেদন করতে ব্যস্ত। এই লড়াইটাকে তিনি নিয়ে যাচ্ছেন ‘প্রযুক্তিগত’ এবং ‘বাণিজ্যগত’ লড়াইয়ের দিকে। সে ব্যাপারে ভারতকে সঙ্গে নিতে চাইছে আমেরিকা। চীনের যে ‘সিভিল মিলিটারি ফিউশন’ নীতি অর্থাৎ সামরিক এবং প্রশাসনিক—সবটাই মিলেমিশে গিয়ে একটা অদ্ভুত চীননীতি রয়েছে, সেটার মোকাবেলা করার জন্য একটা ‘স্ট্র্যাটেজিক টেকনোলজি’র প্রতিযোগিতার পথে কিন্তু আমেরিকা যেতে চাইছে। কেননা ‘প্রযুক্তিগত’ পথে চীন অনেকটা এগিয়ে গেছে।

ভারতকেও আমেরিকা বলছে, অবিলম্বে ‘প্রযুক্তিগত’ একটা আলাদা বিভাগ তৈরি করতে হবে এবং সেখানে জাপান ও আমেরিকার নেতৃত্বে এক্ষুনি ভারত-জাপানকে সঙ্গে নিয়ে চীনকে মোকাবেলা করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, একদিকে সন্ত্রাস! আফগানিস্তানের দিকে নজর না দিলেও ভারত বারবার আমেরিকাকে বলছে, তারা যেন ‘সার্ভেইল্যান্স এয়ার স্ট্রাইক’ বন্ধ না করে এবং যেকোনো মূল্যে সেটাকে আটকাতে হবে।

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে এই উপমহাদেশে নিরাপত্তাজনিত একটা সমস্যা যে দেখা দিচ্ছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৯৮ সালে ভারত যখন ‘পরমাণু পরীক্ষা’ করেছিল, তখন ভারতের সঙ্গে আমেরিকার ‘পোখরান বিস্ফোরণ’ নিয়ে যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল, পরবর্তীকালে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ‘পরমাণু চুক্তি’র ফলে সেই পরিস্থিতিটা কিন্তু সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল এবং ভারত আর আমেরিকার মধ্যে একটা সুষ্ঠু সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।

ট্রাম্প যত দিন ছিলেন তাঁর অনেক রকমের সমস্যা ছিল। ট্রাম্প আমেরিকাকেই কার্যত ভাগ করে দিয়েছিলেন। তাঁর সময় নতুন করে ‘বর্ণভেদ’ প্রথা এসে গিয়েছিল, যা ইউরোপকে একেবারে আতঙ্কিত করে রেখেছিল। মধ্যপ্রাচ্যকে সংশয়ের মধ্যে রেখেছিল। আফ্রিকাকে তো প্রায় পৃথিবীর বাইরে বের করে দিতে চেয়েছিলেন। রাশিয়ার ক্ষেত্রে একটা মিশ্র অনুভূতি ছিল। কখন যে বন্ধুত্ব আর কখন যে শত্রুতা, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল না।

আর যা-ই হোক, রাত জেগে টুইট করে ভারত বিরোধিতা, এতটা বাড়াবাড়ি কিন্তু ট্রাম্প করেননি। পাকিস্তান ও চীন প্রশ্নে ট্রাম্প খুব বেশি ভারতের পাশে ছিলেন। সন্ত্রাসের প্রশ্নেও নরেন্দ্র মোদি এবং ট্রাম্প কিন্তু অনেকটাই কাছাকাছি ছিলেন। এখন যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে একদিকে যে রকম ভারতের নিরাপত্তার অভাব বোধ হচ্ছে, আরেক দিকে চীনকে মোকাবেলা করার জন্য আমেরিকার সঙ্গে অনেক বেশি কাছাকাছি আসা এবং প্রযুক্তিগতভাবে চুক্তি করার ফলে আজকের নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। অর্থাৎ একটা সময় যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন বনাম আমেরিকার ঠাণ্ডা যুদ্ধ ছিল, আজ চীন আর আমেরিকার যুদ্ধ চলেছে। এ ক্ষেত্রে যদি ভারসাম্য রক্ষা না করে ভারত পুরোপুরি আমেরিকার দিকেই চলে যায়, তাহলেও বিপদ আছে।

সুতরাং ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য কিন্তু একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ এসেছে আর এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে বাংলাদেশ যেমন আমেরিকার কাছে, তেমন ভারতের কাছেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হতে পারে, কিন্তু তার যে ‘জিওস্ট্র্যাটেজিক পজিশন’ সেখানে বাংলাদেশের গুরুত্ব অসীম! যার ফলে আজ ভারত ও আমেরিকা দুই পক্ষই বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে এক মহান দায়িত্ব পালন করছে।

এই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শেখ হাসিনা সরকার নিজের অবস্থান সুস্পষ্ট রেখেছে। তিনি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের ‘সার্বভৌমত্ব’ রক্ষার পক্ষে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের উচিত বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে, এই নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধে জোটনিরপেক্ষতা বজায় রেখে অগ্রগতির পথে যৌথভাবে অঙ্গীকার নেওয়া এবং এগোনো।

লেখক: সাংবাদিক।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –