• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সর্বশেষ:
মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ইতিহাসে অনন্য: রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা হস্ত‌ক্ষেপ করবে না: ওবায়দুল কাদের লালমনিরহাটে যুবলীগ কর্মীর পায়ের রগ কাটলেন যুবদল নেতা বাসার ছাদ থেকে পড়ে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু ঠাকুরগাঁওয়ে ঈদ-নববর্ষে ১০ জন নিহত, আহত ২ শতাধিক

দশম বিপৎসংকেত পার হতে আওয়ামী লীগের করণীয়

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৬ এপ্রিল ২০২১  

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

দেশের চারদিকে যা ঘটছে তাতে মনে হয় এটা আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য দশম বিপৎসংকেত। কভিড-১৯-এর হামলা আকস্মিকভাবে এতটাই বেড়েছে যে জনজীবনে যেমন বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সরকারকেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করেছে। দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ। সরকারের পক্ষে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া উপায় ছিল না। জনজীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারকে আরো নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। জনগণের উচিত হবে সরকারের প্রতিটি ব্যবস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করা। কভিড-১৯-এর মতো বিশ্ব ত্রাস দানবকে পরাজিত করতে হলে সরকার ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশে কভিড-১৯-এর প্রথম হামলা সরকার দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করে সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল। সরকার সেই সাফল্যকে এবার ম্লান হতে দিতে পারে না। শেখ হাসিনা যোগ্য কাণ্ডারি। তাঁর নেতৃত্বে দেশ অনেক বড় বড় বিপদ ও বিপর্যয়ের মোকাবেলা করেছে। এবারও কভিড-১৯ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ জাতি সেই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারবে—এটা সবার প্রত্যাশা।

কভিড-১৯-এর প্রথম হামলার সময় দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা জনগণের মনোবল রক্ষার জন্য তাঁদের কবিতা, গান, অন্যান্য শিল্পকর্মসহ জনগণের সামনে হাজির হয়েছিলেন। আধুনিক প্রযুক্তি তাঁদের সাহায্য করেছিল। ঘরে বসে অনলাইনের সাহায্যে তাঁরা জনগণের সামনে হাজির হতে পেরেছিলেন। তাঁদের কবিতা, গান ইত্যাদি দ্বারা জনগণের মনোবল বৃদ্ধি করেছিলেন। এবারও এই শিল্পী-সাহিত্যিকদের আরো জোরালো কর্মপ্রচেষ্টা দরকার। কভিড-১৯কে পরাজিত করার জন্য আরো বেশি উদ্দীপনামূলক গান-কবিতা নিয়ে জনগণের সামনে জুমের মাধ্যমে হাজির হতে হবে। সাধারণ মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি না ভাঙে, সে জন্য সরকারি প্রচারমাধ্যমগুলোকে জোর প্রচারকার্য চালাতে হবে।

সরকারের সামনে বিপদ একটি হলে কথা ছিল না। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্প্রতি যে অরাজকতা দেখা দিয়েছে, কভিডের চাইতে তা কম মারাত্মক নয়। দেশে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক শক্তি সক্রিয় হয়েছে। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের ভেতরের কিছু বিভীষণ যে কর্মকাণ্ড শুরু করেছে তা ক্ষমতাসীন দলের জন্য আত্মঘাতী। শেখ হাসিনার জন্য এই অভ্যন্তরীণ কোন্দল একটা বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের জন্য দশম বিপৎসংকেতের সময় দেশবাসীর জন্য একটাই আশার কথা, তাদের জন্য দক্ষ কাণ্ডারি শেখ হাসিনা রয়েছেন। তিনি সাহসী। বিপদ ও বিপর্যয়ের মুখেই তাঁর এই সাহস ও দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। এবারও যে পাওয়া যাবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু শেখ হাসিনার হাতে শক্তি জোগাতে হবে। সেই শক্তি জোগাতে পারে তাঁর দল আওয়ামী লীগ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ প্রভৃতি।

কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের নিজের অবস্থাই ভালো নয়। সর্বত্র অভ্যন্তরীণ কোন্দল বড় হয়ে উঠেছে। নোয়াখালীতে কাদের মির্জার ঘটনা তার বড় প্রমাণ। এ রকম কাদের মির্জা আওয়ামী লীগে আরো কতজন আছেন তা খুঁজে বের করা দরকার। যা প্রয়োজন, স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী এই দলটিকে হাইব্রিড নেতাকর্মীদের কম্বল থেকে মুক্ত করে আবার জনগণের আস্থাভাজন রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনর্গঠন করা। সরকার একা জাতীয় বিপর্যয় মোকাবেলা করতে পারে না, এই সময় শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের কর্তব্য সরকারের হাতে শক্তি জোগানো। আওয়ামী লীগকে এ জন্য সুসংহত হতে হবে।

দলকে সুসংগঠিত করার এমন একটি প্রচেষ্টার আভাস দলের সচেতন নেতাদের কাছ থেকেই সম্প্রতি পাওয়া গেছে। নেহরু যেমন ‘কামরান পরিকল্পনা’ দ্বারা তাঁর কংগ্রেস দলের ভেতর থেকে সব আগাছা দূর করে দলকে সুসংহত করে তুলেছিলেন, আওয়ামী লীগকেও তদ্রুপ সংগঠিত ও শক্তিশালী করে তোলা আবশ্যক। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি আভাস দিয়েছেন, দলকে শুদ্ধিকরণে তাঁরা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। এটা আশার খবর। আওয়ামী লীগ যে দেশে এত জনপ্রিয় ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছিল তার প্রধান কারণ, দলটি বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মতো সার্বক্ষণিক যোগ্য সাধারণ সম্পাদক পেয়েছিল। আওয়ামী লীগে তখনই দুর্বলতা দেখা দেয়, যখন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান দলটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি সার্বক্ষণিক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন না। দল পরিচালনায় তাঁর যোগ্যতার অভাব ছিল না। কিন্তু একদিকে মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব, অন্যদিকে দল পরিচালনা—দুটি দায়িত্ব সমান দক্ষতার সঙ্গে পালন তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

দলকে সংগঠিত ও শক্তিশালী রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু একসময় মন্ত্রিত্বের পদ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের সার্বক্ষণিক সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন দলের সভাপতির পদ ত্যাগ করে মন্ত্রী কামারুজ্জামানকে ওই পদে বসিয়েছিলেন। কামারুজ্জামান মন্ত্রী পদ ত্যাগ করেছিলেন।

বর্তমানে পরিস্থিতি বদলে গেছে। দল বড় হয়েছে। অবস্থাও জটিল হয়েছে। এ ধরনের অবস্থায় ভারতে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর পদে বসে কংগ্রেস দলকে ভাগ করেছেন এবং ইন্দিরা কংগ্রেস গঠন করেছেন। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সৌভাগ্য, গোটা আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকন্যার অনুগত ছিল এবং আছে। শেখ হাসিনাকে দল ভাগ করতে হয়নি। দল তাঁকে সভানেত্রীর পদে বসিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই পদে তাঁর থাকা দরকার।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদের গুরুদায়িত্ব বহনের পর দলের ভালো-মন্দ দেখার সময় প্রধানমন্ত্রীর কতটুকু থাকে—সেটাই আজ প্রশ্ন। সে জন্য আমি বেশ কিছুকাল আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম শেখ রেহানাকে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করার জন্য। শেখ হাসিনা রাজি হয়েছিলেন, রাজি হননি শেখ রেহানা। যা হোক, কিছুকাল পর ওবায়দুল কাদের দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে ওবায়দুল কাদেরের বয়স বেশি নয়, ছাত্রজীবনের রাজনীতি থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। সে জন্য জেল-জুলুমও ভোগ করেছেন। তাঁর মধ্যে আওয়ামী লীগ একজন দক্ষ সাধারণ সম্পাদক পেয়েছিল বহুকাল পর। কিন্তু দুর্ভাগ্য আওয়ামী লীগ সংগঠনটির। ওবায়দুল কাদের হঠাৎ গুরুতর রোগাক্রান্ত হন। তাঁর জীবনের আশা ছিল না। দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর তিনি সুস্থ হয়েছেন বটে; কিন্তু এখনো সবল হতে পারেননি। তাঁর ওপর দেশব্যাপী কভিড-১৯-এর উপদ্রব। ওবায়দুল কাদের দল শুদ্ধিকরণের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, সেই পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করতে পারেননি।

ভারতে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর কংগ্রেসে যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দেয়, সেই কোন্দলই দলটাকে শেষ করে দিয়েছে। ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস এখন হিরো থেকে জিরো। আমার একান্ত প্রার্থনা, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের এই অবস্থা যেন না ঘটে। শেখ হাসিনা যত দিন দলের নেতৃত্বে আছেন, তত দিন এটা ঘটবে মনে হয় না। শেখ হাসিনা পলিটিশিয়ান থেকে স্টেটসম্যানে পরিণত হয়েছেন। সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাঁর নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা। দেশে তাঁর নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। তাঁর দরকার দলটির কাজে কিছু সময় দেওয়া এবং শক্ত হাতে দলটির সংস্কার ও পুনর্গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা। দুর্নীতিবাজ নব্য আওয়ামী লীগারদের দল থেকে বহিষ্কার করা।

বাংলাদেশের সামনে আজ দশম বিপৎসংকেত, যা আগেই উল্লেখ করেছি। তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এখনো ক্ষমতায় আছেন বলে আশা করছি এই দশম বিপৎসংকেতও তিনি আগের বিপর্যয়গুলোর মতো অতিক্রম করতে পারবেন। দেশের রাজনীতি আজ একদল নব্য ধনীর কবলে। তাদের মধ্যে রয়েছে একদল দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী। দেশের জাতীয় সংসদের আসনের শতকরা ৬৫ ভাগ ব্যবসায়ীদের কবলে। দেশের মিডিয়াও তাই। এই অবস্থাটা সৃষ্টি করে গেছেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের অন্যতম নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। দেশকে অসৎ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ ধ্বনি তুলে স্যুটকেসসর্বস্ব ব্যবসা দ্বারা ব্যাংকের ঋণখেলাপি একটি নব্য ধনী ও ব্যবসায়ী শ্রেণি তৈরি করেন। কচুরিপানার মতো এদের বংশ ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এরাই এখন দেশের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে।

এদের কবল থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেও দেশকে উদ্ধার করা একটি অসম্ভব কাজ। সেই অসম্ভব কাজটি সম্পন্ন করারই দায়িত্ব পড়েছে শেখ হাসিনার কাঁধে। তিনি এখন ইমপসিবল মিশনের নেত্রী। এই সময় শক্তিশালী গণসংগঠনের সমর্থন পেছনে না থাকলে তার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না। এই লক্ষ্য অর্জনে আওয়ামী লীগই তার সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি হবে, যদি তিনি আওয়ামী লীগের আগের সাংগঠনিক শক্তি ফিরিয়ে আনেন। সেই সঙ্গে যদি যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মন নিয়ে তিনি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দমন করেছেন, দেশ থেকে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস উচ্ছেদ করেছেন, একটি তথাকথিত সুধীসমাজের অন্তর্ঘাতমূলক চক্রান্ত মোকাবেলা করেছেন, সেই একই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মন নিয়ে তিনি দলের ভেতরের ও বাইরের দুর্নীতিবাজ ও ধর্মব্যবসায়ীদের শায়েস্তা করার পদক্ষেপ নেন, তাহলে তিনি দেশকে যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দান করেছেন, তেমনি দেশের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও শোষক, লুটেরা ও সাম্প্রদায়িক শক্তির কবল থেকে মুক্ত করার যুদ্ধ শুরু করতে পারবেন।

আওয়ামী লীগে শক্তিশালী নেতৃত্ব আছে। দলের সামনে সুস্পষ্ট নীতি নির্ধারিত হয়ে আছে। তা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নীতি; যে নীতি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজবাদের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। শুধু মুজিবকোট পরিধান করে মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বুলি কপচালেই আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবে না। এই মুজিববর্ষে তাদের প্রতিজ্ঞা হবে আদর্শবান ও ত্যাগী মুজিববাদী হওয়ার। দশম বিপৎসংকেত অতিক্রম করার কাজে তাদের দরকার নিজেদের সংশোধন দ্বারা শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে এর বিকল্প কোনো পথ তাদের সামনে নেই।

লন্ডন, সোমবার, ৫ এপ্রিল ২০২১

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –