• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

প্রত্যাশার প্রত্যাবর্তন

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১০ জানুয়ারি ২০২১  

আবদুল মান্নান

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, সোমবার। দুই দিন ধরে পাকিস্তানের দখলদারমুক্ত নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে একজন মানুষের দেশে ফেরার জন্য। মানুষটি আর কেউ নন, বাংলার বন্ধু, যাঁকে তাঁর দেশের মানুষ নাম দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। পাকিস্তানের শাসনামলের ২৩ বছরের ১৩ বছর তিনি পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন, দুইবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁর একমাত্র অপরাধ তিনি আজীবন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে যে আচরণ করেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের বৈষম্যমূলক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গোড়ার ইতিহাসে ফিরে গেলে এটা তো এখন পরিষ্কার, পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উত্তর ভারত, পাঞ্জাবের এলিট শ্রেণি ও সেখানকার ভূস্বামীদের স্বার্থ রক্ষা করা। ভারতের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা হয়ে উঠেছিল গৌণ। যতসংখ্যক মুসলমান নিয়ে পাকিস্তান যাত্রা শুরু করেছিল তার চেয়ে বেশিসংখ্যক মুসলমান তো ভারতে রয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শোষণ-শাসনের শেষ পরিণতি বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বাঙালি নিধনের এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অত্যন্ত অমর্যাদাকরভাবে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এক দিন পর তাঁকে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি হয়ে পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালি কারাগারে কারারুদ্ধ করে তাঁর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ উত্থাপন করে, যার একটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ। রাষ্ট্রদ্রোহের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ৯ মাস বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। সব শেষে তাঁর বিচার শুরু হয়েছিল আগস্ট মাসে মিয়ানওয়ালি কারাগারে। ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিদেশি সাংবাদিককে বলেছিলেন, তিনি শুরুতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রখ্যাত আইনজীবী এ কে ব্রোহি তাঁর পক্ষে আদালতে আইনি লড়াই করুক। কয়েকটি কার্যদিবস শেষে বঙ্গবন্ধুর কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, বিচারের নামে যা চলছে তা স্রেফ প্রতারণা। আসল উদ্দেশ্য তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো। তিনি তাঁর নির্বাচিত আইনজীবীকে নিষেধ করেছিলেন বিচার নামের এই তামাশার অংশী হতে।

ভাগ্য বলে একটা কথা আছে। কথিত বিচারকাজও প্রায় শেষ, ঠিক তখনই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। যদিও পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি; কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধে শুধু যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা-ই নয়, পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে তখন পাকিস্তান সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত। একদিকে তাদের শোষণের বড় ক্ষেত্র পূর্ব বাংলা হাতছাড়া হয়ে গেল, অন্যদিকে পশ্চিম অংশও যায় যায় অবস্থা। এই সময় সেই অংশ রক্ষা করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে রয়েছে আন্তর্জাতিক চাপ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর অবশিষ্ট পাকিস্তানব্যাপী তীব্র গণ-অসন্তোষের মুখে ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ করে পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

ভুট্টো এটি ঠিক আঁচ করতে পেরেছিলেন, জিন্নাহর পাকিস্তানের এখন আর অস্তিত্ব নেই। তিনি পুরনো পাকিস্তানের একটি অংশের মাত্র প্রেসিডেন্ট। ভুট্টো শেষ চেষ্টা করতে চান জিন্নাহর পাকিস্তানকে রক্ষা করতে। বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে আনা হলো রাওয়ালপিন্ডির  কাছের একটি রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায়। ভুট্টো এলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। বঙ্গবন্ধু তখনো ঠিক জানেন না সার্বিক পরিস্থিতি। তবে ভুট্টোর কথায় তিনি বুঝে গেলেন বাংলাদেশ স্বাধীন আর ভুট্টো একটি খণ্ডিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। ভুট্টো অনেকটা অনুনয় করে বঙ্গবন্ধুর কাছে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন পাকিস্তানের সঙ্গে একটি যোগসূত্র রাখেন। বঙ্গবন্ধু জনমানুষের নেতা। তিনি তাঁর জনগণের সঙ্গে আগে কথা বলতে চান জানিয়ে দিলেন ভুট্টোকে। ভুট্টোর অসহায়ত্ব ঠিকই বুঝে গেছেন বঙ্গবন্ধু। ভুট্টো সত্তরের নির্বাচনের পর ইয়াহিয়ার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে, তিনি আজ নিজেই তার সেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে খণ্ডিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধুকে তিনি পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে জানুয়ারির ৮ তারিখ লন্ডনে পাঠিয়ে দিলেন। তখন দিল্লিতে অবস্থান করছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ এবং বাংলাদেশ সরকারের বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁরা ভারত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন, যার অন্যতম ছিল ভারত থেকে এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর দেশে ফেরা। প্রয়াত কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরী তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনের বালুকাবেলায়’ লিখেছেন, ‘অকস্মাৎ আলোচনা কক্ষের দরজাটা সশব্দে খুললেন মানি দীক্ষিত (জে এন দীক্ষিত, ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা, পরবর্তীকালে নিরাপত্তা উপদেষ্টা)। এই মাত্র খবর এসেছে শেখ মুজিব মুক্তি পেয়েছেন। খবর তিনি ইতোমধ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করেছেন। ভেঙে গেল বৈঠক, সম্মেলনকক্ষটি ভেঙে পড়ল স্বতঃস্ফূর্ত করতালিতে।’

৮ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি লন্ডন পৌঁছাল। তাঁকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানালেন লন্ডনে অবস্থানরত বাঙালি কূটনীতিবিদ রেজাউল করিম ও মহিউদ্দিন আহমেদ। তাঁরা দেখলেন দীর্ঘ কারাবাসের কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। আসলে তাঁর ওজন প্রায় ৪০ পাউন্ড কমে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু উঠলেন লন্ডনের অভিজাত হোটেল ক্লারিজেসে। ক্লান্ত বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজন ছিল বিশ্রাম; কিন্তু তৎক্ষণে খবর রটে গেছে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা লন্ডনে। তাঁকে একনজর দেখার জন্য হোটেলের পাশের রাস্তায় লেগে গেল ভিড়। তাঁর হোটেলকক্ষে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু অবহিত হয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, আর প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব সম্পর্কে। কথা বলে নিয়েছেন কয়েকজন নেতার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণে অন্য উচ্চতায়। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিলেন ঠিক যেমন একজন রাষ্ট্রনায়কের দেওয়া উচিত। বিশ্বের মানুষ অন্য আরেক বঙ্গবন্ধুকে চিনল, শুনল, জানল।

পরদিন ৯ জানুয়ারি। লন্ডন সময় রাত ৮টা। বাংলাদেশে তখন রাত ২টা। ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া একটি বিশেষ কমেট বিমানে জাতির পিতা লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের পথে রওনা হলেন। বিমানবন্দরে স্বাধীন দেশের স্থপতিকে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে বিদায় জানাতে এসেছিলেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। সেই রাতে বাংলাদেশের অনেক মানুষ নির্ঘুম কাটিয়েছেন। অনেকে নফল নামাজ পড়েছেন, রোজা রেখেছেন। বিমানটির প্রথম গন্তব্য ভারতের রাজধানী দিল্লি। মাঝপথে জ্বালানি নেওয়ার জন্য কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতি সাইপ্রাসের নিকশিয়া ও বাহরাইনে। লন্ডন ছাড়ার আগে ভারতের হাইকমিশনার টেলিফোনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ৩০ মিনিট ধরে চলল সেই আবেগঘন আলোচনা।

১০ই জানুয়ারি সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করল। দিল্লিতে জানুয়ারি মাসে শীতের প্রকোপটা তীব্র। সব প্রটোকল ভেঙে পালাম বিমানবন্দরে তখন উপস্থিত ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আছেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। বঙ্গবন্ধু আভিধানিক অর্থে তখন মাত্র একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য, একজন সিভিলিয়ান। তাঁর কোনো শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়নি। দিল্লি বিমানবন্দরে এই সময় ঘটল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী তখন সন্তানসম্ভাবনা। হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বায়না ধরলেন, তিনি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটার সাক্ষী হয়ে থাকতে চান। বিশেষ অ্যাম্বুল্যান্সে সোনিয়াকেও বিমানবন্দরে আনা হলো। দেখলেন তিনি তাঁর জীবনের প্রথম একজন মহানায়ককে। এর দুই দিন পর প্রিয়াঙ্কার জন্ম হয়। একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে যেসব প্রটোকল দেওয়া হয় ঠিক একই প্রটোকল দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানো হয় বিমানবন্দরে। ফারুক চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, “(সকাল) আটটা বেজে দশ মিনিট। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দেয়া রুপালি কমেট বিমান। ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন কর্ণভেদী নীরবতা। সিঁড়ি লাগল। খুলে গেল দ্বার। দাঁড়িয়ে সহাস্যে, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু, নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের দুটি শব্দ। ‘জয় বাংলা’। তখন দিল্লির সকল ধরনের ভিভিআইপি আর সাংবাদিকদের ভিড়ে পালাম বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীদের অবস্থা কাহিল। বিমান হতে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন ভারতের রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সম্মানে দাগা হলো কামান একুশবার। তারপর একটি চৌকস সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার। দিল্লিতে প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর ব্রাস ব্যান্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজানো হলো ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’।”

বিমান থেকে নামার পর সব প্রটোকল শেষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের সেনানিবাসের ময়দানে। সেখানে তিনি সেই শীতের সকালে উপস্থিত কয়েক হাজার মানুষের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। কিছুটা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য। তবে বাদ গেল না কোনো প্রসঙ্গ। ভারত সরকারের সাহায্য আর ভারতের আপামর গণমানুষের সহায়তা আর ত্যাগের কথা। বাংলার বন্ধু মাঝে মাঝে আবেগপ্রবণ, কখনো অশ্রুসিক্ত। কথা ছিল তিনি ইংরেজিতে ভাষণ দেবেন। কিন্তু অনেকটা জনগণের দাবিতে তিনি বললেন বাংলায়। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় অনুরোধ করেছেন বঙ্গবন্ধু যেন যাত্রাপথে কলকাতা হয়ে যান। বিনয়ের সঙ্গে তিনি জানালেন, যাওয়ার পথে কেন? যেই রাজ্যের মানুষ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এত ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের পৃথকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে তিনি অতিসত্বর কলকাতা আসবেন। আর তিনি এও জানতেন, তাঁকে বরণ করে নেওয়ার জন্য নিজের দেশে কোটি মানুষ অপেক্ষা করছে। শীতের দিনের বেলা তাড়াতাড়ি ফুরায়। ৫টায় সন্ধ্যা নামে। আলো থাকতে তাঁকে ঢাকায় ফিরতে হবে।

কথা ছিল দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধু ঢাকা পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতির বিশেষ বিমান ‘রাজহংসে’ ভ্রমণ করবেন আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বিমানটি দিল্লি থেকে লন্ডন ফিরবে। এরই মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বিমান থেকে মালপত্র ‘রাজহংসে’ তোলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এই সময় জানিয়ে দিলেন, তিনি ভারত সরকারের প্রতি বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করার জন্য কৃতজ্ঞ, তবে যাত্রার মাঝপথে ব্রিটিশ বিমান ছেড়ে দেওয়াটা অসৌজন্যমূলক হবে। সুতরাং বাকি পথটাও তিনি একই বিমানে যাবেন। আবার মালপত্র স্থানান্তর হলো। দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুর যাত্রা সঙ্গী হয়েছিলেন ফারুক চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের সেই প্রসন্ন অপরাহ্নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অনুধাবন করেছিলাম যে আমাদের নবীন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে কূটনীতি আর কূটনৈতিক আচরণে দীক্ষা লাভের আমার রয়েছে যথেষ্ট অবকাশ।’

দুপুরের কিছু পর বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ব্রিটিশ বিমান দিল্লি ছাড়ল। তখন শুধু ঢাকা বিমানবন্দর বা রমনা রেসকোর্স নয়, মনে হচ্ছিল ঢাকা শহরের কোনো মানুষ ঘরে নেই। সবাই রাস্তায়। সবাই দেখতে চায় ইতিহাসের বরপুত্রকে। পড়ন্ত বিকেলে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করল। বিমানের দরজা খুলল। দরজায় এসে দাঁড়ালেন ইতিহাসের সেই বরপুত্র শেখ মুজিব, যাঁর জন্য দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন প্রবাসী সরকারের নেতারা। দেওয়া হলো নতুন দেশের চৌকস নতুন সেনাবাহিনীর গার্ড অব অনার। বঙ্গবন্ধুকে ওঠানো হলো একটি খোলা ট্রাকে। জনগণের নেতাকে জনগণ দেখতে চায়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! নিয়ে যাওয়া হলো রমনা রেসকোর্সে, যেখানে লাখো জনতা তাদের মহানায়কের জন্য অপেক্ষা করছে। এ যেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পুনরাবৃত্তি।

কী হতো বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা হত্যা করলে? তিনি যদি কারাগার থেকে মুক্ত না হতেন?  ৪৯ বছর পর চিন্তা করলে উত্তরে তেমন ভালো একটা কিছু পাওয়া কঠিন। প্রবাসী সরকার গঠন করার সময় কারা সরকার গঠন করবে তা নিয়ে কিছু টেনশন তো ছিলই। একদিকে আওয়ামী লীগের ভেতর একটি মহল চেয়েছিল বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে একটি সরকার গঠন করা হোক। সেনাবাহিনীর একাংশ চেয়েছিল সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী কমান্ডো কাউন্সিল হোক। এটা হলে বিশ্ব মনে করবে এটি কোনো স্বাধীনতাসংগ্রাম নয়, এটি একটি সেনা বিদ্রোহ। এই দুটির কোনোটা হলে ভারতের সহায়তা পাওয়া কঠিন বা অসম্ভব হতো। শুধু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দিয়ে সরকার গঠন করাই সর্বোত্তম বিকল্প। তাই হয়েছিল। কিন্তু দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পরও এই সমস্যা থেকেই যায়। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেই সেদিন এই সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছিল। তখন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার হাতে অস্ত্র। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ক্ষমতার টানাটানিতে দেশে শুরু হতে পারত এক ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্বের কাছে সব পরাভূত হয়েছিল। তাঁর ডাকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়েছিল। ফিরে গিয়েছিল স্বাভাবিক জীবনে।

দেশে তখন কয়েক হাজার ভারতীয় সেনা। অন্য দেশের সেনা অপ্রয়োজনে আরেক দেশে থাকলে ক্ষতি হয় সেই দেশের সার্বভৌমত্বে। এটা মানতে রাজি নন বঙ্গবন্ধু। কথা বললেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দিলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আগেই ফিরে যাবে ভারতীয় সেনা নিজ দেশে। কথা রেখেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ১২ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতের বিদায়ি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে সালাম জানাল। ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন।

জানুয়ারির ১২ তারিখে বঙ্গবন্ধু বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করে সংসদীয় গণতন্ত্রের রেওয়াজ অনুযায়ী তাঁর নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী আর প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী। হাত দিয়েছিলেন একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের কাজে। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে তিনি যত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছিলেন তাঁকে হত্যা-পরবর্তীকালে অন্য কোনো সরকারকে এত কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়নি।  হাজারো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁর সেই সাড়ে তিন বছর ছিল সার্বিক বিচারে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনকাল। তবে এই শাসনকালে তাঁর এবং দেশের যতটুকু ক্ষতি করেছে তার বেশির ভাগ করেছে সেই সব মানুষ, যাদের তিনি বিশ্বাস করতেন। এই দীর্ঘ সময় পরও মনে হয় না পরিস্থিতির তেমন একটা পরিবর্তন হয়েছে, বরং তা বহুমাত্রিক হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আর আমাদের মাঝে ফিরবেন না; কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া পদচিহ্ন বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। বাংলা ও বাঙালির জয় হোক। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি অমর হোক। জয় বাংলা।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক।

সূত্র: কালেরকণ্ঠ।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –