• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

সর্বশেষ:
বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ফেলেছে ক্রমবর্ধমান জলরাশি: গবেষণা উত্তরবঙ্গের মহাসড়কে চার লেন চালু, ঈদযাত্রা হবে স্বস্তির সব উন্নয়ন সহযোগীদের এক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী বিডিএস ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে: ভূমিমন্ত্রী বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা দিতে হবে: ওবায়দুল কাদের

প্রশংসনীয় বাজেট এবং কিছু বিবেচ্য বিষয় নিরঞ্জন রায়

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৫ জুন ২০২১  

নিরঞ্জন রায়

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট পেশ করেছেন। দেশ যেহেতু এ বছর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে, তাই এবারের বাজেটও সুবর্ণ জয়ন্তী বাজেট। বিগত ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতির উন্নতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজেটের আকারও বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বিশেষ করে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একটানা সরকার পরিচালনার সুযোগ পেয়ে যেভাবে ক্রমবর্ধমান হারে দেশের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছেন, তাতে তাঁর এই উদ্যোগ সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থেই প্রতিবছর বিশাল আকৃতির বাজেট গ্রহণ করতে হয়। আর এই বৃহৎ বাজেটের কারণেই দেশের অর্থনীতির ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে এবং আগামী দিনেও থাকবে।

সবচেয়ে কঠিন সময়ের বাজেট : বর্তমান সময়ে বাজেট পেশ করা যেকোনো দেশের সরকারের পক্ষেই বেশ দুরূহ কাজ। কেননা সারা বিশ্ব করোনা মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে একেবারে বিপর্যস্ত। কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে না। মানুষের জীবন-জীবিকা ঠিক রাখতে গিয়ে কখন কিভাবে এবং কত পরিমাণ অনির্ধারিত জরুরি ব্যয়ের প্রয়োজন হবে, তা কেউ বলতে পারবে না। এমন এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে সরকার যেভাবে বিগত বছরগুলোর বাজেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং দেশের উন্নয়নের গতি ঠিক রাখার উদ্দেশ্য সামনে রেখে যে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পেশ করতে পেরেছে তা এককথায় প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বাজেটের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা থাকবেই। কেননা একেকজন একেক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেন বিধায় বিশ্বের কোনো বাজেটই আলোচনা-সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। সবচেয়ে বড় কথা, সরকার বিগত বছরের বাজেটের ধারাবাহিকতা এই করোনাকালীন জরুরি এবং অনিশ্চিত সময়ের বাজেটেও বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

বাজেটের আকার : ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম যে জাতীয় বাজেট পেশ করেছিল তার পরিমাণ ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। আর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এসে সেই আওয়ামী লীগ সরকারই যে বাজেট পেশ করল তার পরিমাণ ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। পার্থক্য এটুকুই যে দেশের প্রথম বাজেট যখন প্রণীত হয়েছিল তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতায় আর এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। শুধু তা-ই নয়, এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় যে দীর্ঘ ৫০ বছরে স্বৈরাচারসহ বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় ছিল এবং তারাও বাজেট পেশ করেছে প্রতিবছর। কিন্তু অন্যান্য সরকারের শাসনামলে প্রতিবছর যে হারে বাজেটের আকার বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হারে বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই। এরশাদ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে বিএনপি ১৯৯১-৯২ সালের জন্য ১৫ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে শুরু করে ক্ষমতা ছাড়ার আগে ১৯৯৪-৯৫ সালে বাজেট দিতে পেরেছিল ২০ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকার। অর্থাৎ তাদের সেই সময়ের শাসনামলে জাতীয় বাজেটের আকার বেড়েছিল ৩৫ শতাংশ। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়ে ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরের জন্য ২৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে শুরু করে ক্ষমতা ছাড়ার আগে ২০০০-০১ অর্থবছরের জন্য ৩৮ হাজার ৫২৪ কোটি টাকার বাজেট দিতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সেই সময়ের পাঁচ বছরের শাসনামলে বাজেটের আকার বৃদ্ধি পায় প্রায় ৫৭ শতাংশ। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বেঁধে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে ২০০২-০৩ অর্থবছরের জন্য ৪৪ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে শুরু করে ক্ষমতা ছাড়ার আগে ২০০৫-০৬ সালে ৬১ হাজার ৫৮ কোটি টাকার বাজেট দিতে সক্ষম হয়েছিল। বিএনপির দ্বিতীয় মেয়াদের সময়কালে বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়, যার মধ্যে মেগাপ্রকল্প, বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি খাতে অগ্রাধিকার প্রদান এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি। এর ফলে প্রতিবছর ক্রমবর্ধমান হারে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০-১১ সালের জন্য বাজেট দিয়েছিল এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকার। ১০ বছর পরে এসে সেই আওয়ামী লীগ সরকারই ২০২১-২২ সালের জন্য বাজেট দিয়েছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার। অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের এক যুগ শাসনামলে বাজেটের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৫৭ শতাংশ। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি হারে, দেশের উন্নতিও সাধিত হয় চোখে পড়ার মতো এবং সেই সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার মানেরও উন্নতি ঘটে। এটাই বৃহৎ বাজেটের মূল সার্থকতা, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে চলেছে ধারাবাহিকভাবে।

ঘাটতি বাজেট বনাম উদ্বৃত্ত বাজেট : প্রতিটা বাজেট ঘোষণার পর ঘাটতি বাজেট না উদ্বৃত্ত বাজেট, এ নিয়ে চলে আলোচনা-সমালোচনা। এবারও নিশ্চয়ই এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না। অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুযায়ী বাজেট সাধারণত তিন ধরনের হতে পারে—উদ্বৃত্ত বাজেট, ঘাটতি বাজেট এবং ব্যালান্সড বাজেট। উদ্বৃত্ত বাজেট কদাচিৎ চোখে পড়ে, আর ব্যালান্সড বাজেট প্রায় অবাস্তব। ফলে ঘাটতি বাজেটই সাধারণত দেখা যায়। তা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশে ঘাটতি বাজেট হবে—এটাই স্বাভাবিক। কারণ দেশকে এগিয়ে নিতে হলে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হাতে নিতে হয়। এসব উন্নয়ন ব্যয় নির্বাহ করার জন্য ঘাটতি বাজেট গ্রহণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না। ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন মোটেই কোনো সমস্যা নয়। দেখার বিষয় ঘাটতি ব্যয় মেটানো হবে কিভাবে। তা ছাড়া আমাদের বাজেটের দুটি অংশ থাকে। প্রথম অংশ রাজস্ব বাজেট এবং দ্বিতীয় অংশ মূলধন বা উন্নয়ন বাজেট। আমাদের রাজস্ব বাজেট সব সময় উদ্বৃত্ত থাকে এবং উন্নয়ন বাজেটে ঘাটতি থাকে। যেহেতু রাজস্ব এবং উন্নয়ন বাজেটকে একত্র করে জাতীয় বাজেট হিসেবে পেশ করা হয়, সে কারণেই সার্বিক বাজেটকে ঘাটতি বাজেট হিসেবেই উপস্থাপিত হয়। ২০২১-২২ সালের বাজেটে রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা, যার বিপরীতে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ রাজস্ব বাজেট ঠিকই উদ্বৃত্ত বাজেট, যেখানে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ১১ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেটের কারণেই সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা দেশজ মোট উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ৬.২ শতাংশ। এই ঘাটতি সহনীয় মাত্রায়ই আছে এবং দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এ রকম ঘাটতি বাজেট সব সময়ই প্রশংসনীয়। একটি কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন, রাজস্ব বাজেটের অর্থ দিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন সূত্র থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সংগ্রহ করতে হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দীর্ঘ মেয়াদের বন্ড ইস্যু করে সব উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের সরকারও ১০০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করেছে এই উন্নয়নকাজের অর্থ সংগ্রহের জন্য। আমাদের দেশের অর্থনীতির উন্নতি এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে দেশের ক্রেডিট রেটিংও উন্নত হয়েছে। তাই আমাদের সরকারও চাইলে ৫০ বছর মেয়াদি সার্বভৌম বা সভরেইন বন্ড ইস্যু করতে পারে। এভাবে দীর্ঘমেয়াদি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার মাধ্যমে যদি মূলধন বা উন্নয়ন বাজেটকে পৃথক করে শুধু রাজস্ব বাজেটকেই জাতীয় বাজেট হিসেবে প্রতিবছর পেশ করা হয়, তাহলে সরকারকে আর ঘাটতি বাজেট পেশের সমালোচনায় পড়তে হবে না। কারণ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড একটি চলমান প্রক্রিয়া, যার ব্যয় বরাদ্দ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তা ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ বেশ দীর্ঘ হয়ে থাকে, যার আয়-ব্যয় বছর বছর পেশ করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং এর আকার যেভাবে এগিয়ে চলেছে তাতে গতানুগতিক ধারার বাজেটের পরিবর্তে আধুনিক বাজেট প্রণয়নের চিন্তা করারও সময় এসেছে।

সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে টিন বাধ্যতামূলক : আমার কাছে এই বাজেটের সবচেয়ে খারাপ দিক মনে হয়েছে দুই লাখ টাকার ওপরের সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার ক্ষেত্রে টিন (ট্যাক্স আইডেনটিফিকেশন নম্বর) বাধ্যতামূলক করা। বাজেটের এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষকে মারাত্মক এক সমস্যায় ফেলবে। যাঁরা সঞ্চয়পত্রে অর্থ জমা রেখে সেই উপার্জন দিয়ে সংসার চালান, তাঁরা মারাত্মক এক বিপদের সম্মুখীন হবেন। বাজেটের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছায় অনেক দেরিতে এবং পরোক্ষভাবে। অথচ এই সিদ্ধান্তের কারণে জনগণ তাত্ক্ষণিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ফলে সরকারের প্রশংসনীয় এই বিশাল বাজেটের সুনামের চেয়ে দুর্নামই বেশি হবে শুধু এই সিদ্ধান্তের কারণে। প্রত্যেকের জন্য টিন সংগ্রহ সহজলভ্য এবং তা প্রাপ্তি নিশ্চিত না করে বাজেটের মাধ্যমে এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। আশা করব অর্থমন্ত্রী বিষয়টির ক্ষতিকর দিক বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেবেন।

লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
[email protected]

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –