• সোমবার ০৬ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২২ ১৪৩১

  • || ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

উদার রাষ্ট্র গড়ব ॥ একুশের চেতনায় দৃঢ় অঙ্গীকার

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২  

সেই মানুষের ঢল, জনস্রোত আবারও দেখা গেল। করোনাকালেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদী ভরে উঠলো ফুলে ফুলে। গভীর শ্রদ্ধায় ভালবাসায় ২১ ফেব্রুয়ারি সোমবার জাতি স্মরণ করল ভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা বীর শহীদদের। সর্বত্র বাজল সেই বেদনা সঙ্গীত: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...। আরও নানা আয়োজনে দেশের প্রতি প্রান্তে পালিত হলো মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

নানা আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি এদিন অমর একুশের অবিনাশী চেতনায় উদার অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলার দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে বাঙালী। ধর্মীয় মৌলবাদ জঙ্গীবাদ ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা দিয়েছে। একুশ মানে মাথা নত না করা। বিদেশীদের মোড়লীপনা, চোখ রাঙানী, ভয় দেখানোর কূটনীতি তাই কাজে আসেনি। বরং নিজ জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির বিপুল জাগরণ দেখেছে বাংলাদেশ।

বাঙালীর ভাষার লড়াই একইসঙ্গে ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ হিসেবে গণ্য হয়। নিজস্ব জাতিসত্তা, স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সংগ্রাম হিসেবেও এর রয়েছে আলাদা তাৎপর্য। অমর একুশের দিনেই পাকিস্তানীদের সবেচেয়ে ভাল চিনতে পেরেছিল পাকিস্তানের পূর্ব অংশের জনগণ। তাদের সঙ্গে যে থাকা যাবে না- বুঝতে পেরেছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতিসত্তার যে স্ফূরণ ঘটেছিল তা-ই পরবর্তিতে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক প্রেরণা যোগায়। বর্তমানে একুশ এবং একাত্তর অভিন্ন চেতনা ও বাঙালী আদর্শের মূর্ত প্রতীক। প্রতিবারের মতো এবারও অমর একুশের দিনে অবিনাশী চেতনার বিজয় প্রত্যক্ষ করেছে দেশ। ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর উদ্যাপনের দিনে শোক ও আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। বরকত রফিক শফিক জব্বারদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এদিন। লাল-সবুজের পতাকার পাশাপাশি ওড়ানো হয় কালো পতাকা। অনেকে বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করেন।

প্রতিবারের মতোই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘিরে ছিল মূল আনুষ্ঠানিকতা। একুশের প্রথম প্রহরে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পাঘ্য অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। করোনাকালীন বাস্তবতায় গত বছরের মতো এবারও সশরীরে সেখানে উপস্থিত হতে পারেননি রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে রাষ্ট্র এবং সরকার প্রধানের পক্ষে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন তাদের দুই সামরিক সচিব। পরে স্পীকার ও তিন বাহিনীর পক্ষে শহীদ বেদীতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বিদেশী দূতাবাসসমূহের কর্মকর্তা, মিশন প্রধানসহ বিদেশী বন্ধুরা।

সরকারী দল আওয়ামী লীগ, সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, সাম্যবাদী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুল দেয়া হয় শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধা জানাতে আসেন অগণিত সাধারণ মানুষ। শহীদ মিনার ঘিরে বিভিন্ন বয়সী মানুষের দীর্ঘ সারি লক্ষ্য করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের জগন্নাথ হল, পলাশী মোড় ছাড়িয়ে নীলক্ষেত ও ইডেন কলেজে গিয়ে ঠেকে অপেক্ষারতদের সারি। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে আসা মানুষের হাতে ছিল ফুল। অনেকে সন্তান বা স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। সকালেও অগণিত মানুষ প্রভাতফেরিতে অংশ নেন। একদিকে চলে ফুল দেয়া, অন্যদিকে সেই ফুলে দারুণ সাজতে থাকে বেদী। অর্ঘ্যরে ফুলে শহীদ মিনারকে চমৎকার সাজিয়ে নেন স্বেচ্ছাসেবীরা। অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য দিনভর ভিড় করেন সাধারণ মানুষ। অজ¯্র ছবি তুলতে দেখা যায় তাদের।

শহীদ মিনার থেকে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল চত্বরে আয়োজন করা মেলা পূর্ণতা পায় এদিন। বাংলা ভাষায় লেখা বইয়ের বিশাল সংগ্রহ এখানে। ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি বই সংগ্রহ করেন পাঠক।

মাতৃভাষা পদক প্রদান ॥ এবার প্রথমবারের মতো জাতীয় পর্যায়ে মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও বিকাশে অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক-২০২১ প্রদান করা হয়। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এ পদক প্রবর্তন করেছে। পদকপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ও মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা। এছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উজবেকিস্তানের গবেষক ইসমাইলভ গুলম মিরজায়েভিচ ও লাতিন আমেরিকার আদি ভাষাগুলো নিয়ে কাজ করা বলিভিয়ার অনলাইন উদ্যোগ এ্যাক্টিভিজমো লেংকুয়াস এ বছর বাংলাদেশ সরকারের এ সম্মাননা পেয়েছেন।

দিনভর অনুষ্ঠান রাজধানীতে ॥ অমর একুশের দিনে ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। বিকেলে বাংলা একাডেমিতে ‘ফিরে দেখা ॥ আমাদের ভাষা আন্দোলন’ শীর্ষক অমর একুশে বক্তৃতা ২০২২ প্রদান করেন কবি আসাদ চৌধুরী। বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা।

বাঙালী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চার পথিকৃৎ ছায়ানট নিজস্ব মিলনায়তনে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

জাতীয় জাদুঘরে ভাষাসংগ্রামীদের স্মৃতি নিদর্শন নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

শিল্পকলা একাডেমিতেও ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষীদের পরিবেশনায় ‘বিশ্বের সব মাতৃভাষা রক্ষা করবে বাংলাদেশ’ শিরোনামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের স্মরণ করা হয়। নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বহুমাত্রিক ভাষা শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার: চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা করেন ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক ড. জমির হোসেন। ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফাদার প্যাট্রিক গ্যাফনি। পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার প্রদান করা হয়।

রাজধানীর পাশাপাশি সারাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান শহীদ দিবস পালন করা হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর নানা দেশে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত ॥ এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে (এনডিইউবি) সোমবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করা হয়েছে। এদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদস্যরা। পরে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করে ভাষা শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক ড. জমির হোসেন ‘বহুমাত্রিক ভাষা শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার: চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক বিষয়ের ওপর আলোচনা করেন। এ সময় বক্তব্য রাখেন এনডিইউবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফাদার প্যাট্রিক গ্যাফনি। শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া বিজয়ীদের পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ইনচার্জ) ড. ফাদার লেনার্ড শংকর রোজারিও উপস্থিত ছিলেন।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –