• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

আলমগীরের স্বপ্নের বিদ্যালয়টি পেয়েছে ‘দেশসেরা’ স্বীকৃতি

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১০ মার্চ ২০২৩  

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবন্ধকতা উত্তরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরিতে ‘দেশসেরা’র স্বীকৃতি পেয়েছে কুড়িগ্রামের সুখাতী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়টি। এ পর্যন্ত বিদ্যালয়টির বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পাঁচটি শিশু স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। সুস্থ হওয়ার পথে আরও ২৩ শিশু। আর এই বিদ্যালয়টির উদ্যোক্তা হলেন আলমগীর হোসেন (৩১) নামের এক তরুণ। 

তিনি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার সুখাতী গ্রামের সৈয়দ আলী ও চায়না বেগম দম্পতির ছেলে। তার বাবা একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আর মা গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে আলমগীর হোসেন সবার বড়। শৈশব থেকে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করার অদম্য ইচ্ছা আজ তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টিকে দেশসেরা স্বীকৃতি এনে দিয়েছে।

আলমগীর হোসেন ২০০৭ সালে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে নাগেশ্বরীর রায়গঞ্জ ডিগ্রি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। কলেজে পড়ার সময় প্রথম চিন্তা করেন তার আশপাশের মানুষদের বিশেষ করে ছিন্নমূল ও অসহায় শিশুদের কষ্ট লাঘবে কাজ করবেন তিনি। এরপর আলমগীর বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের ওপর বিশেষ কোর্স করে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে কাজ শুরু করেন। ২০১৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ৭ বছরে বিদ্যালয়টি ঘিরে আলমগীরের রয়েছে নানা অর্জন। বর্তমানে শিক্ষক ও কর্মচারী মিলে তার প্রতিষ্ঠানে ২৩ জন স্বেচ্ছাসেবক নামমাত্র সম্মানিতে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। ২০২২ সালের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেয়েছে আলমগীর হোসেনের তিলে তিলে গড়ে তোলা সুখাতী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়।

আপন চাচাতো বোনের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সন্তানকে দেখে তিনি ঠিক করেছিলেন সমাজের এসব অবহেলিত শিশুদের নিয়ে কাজ করবেন। তাই বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললেন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও সামাজিক সেবা নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। কিন্তু সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কম-বেশি অনেকে কাজ করলেও, প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে তেমন কাজ করছে না কেউই। শুরু করলেন তার এলাকার অটিজম ও অটিস্টিক বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুরুতে সুখাতী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিজম স্কুলটির একটি দোচালা টিন শেডের ভাড়া করা একটি কক্ষে সব কার্যক্রম  চলতো। প্রথম প্রথম রুম ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে অনেক বেগ পেতে হতো আলমগীরকে। শুরুর দিকে ১৬ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে নিয়ে তার পথচলা শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে তার কাজ দেখে ধীরে ধীরে শিশুদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ১১০ জন শিশু রয়েছে। পরে ভাড়া ঘর ছেড়ে তার দাদুর দান করা ২০ শতক জমির ওপর গড়ে তুলেছেন স্বপ্নের বিদ্যালয়।

বিদ্যালয়টি গড়ে তুলতেও অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন আলমগীর। জমানো টাকা ও নিজের কম্পিউটারের দোকানের পুঁজি ব্যয় করে গড়ে তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটি। তার পরিশ্রমে ধীরে ধীরে পরিচিত হতে থাকে স্কুলটি। প্রথম দিকে তার সহযোদ্ধাদের স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করাতে বেশ বেগ পেতে হতো। লোকচক্ষু আর সম্মানের ভয়ে অনেক অভিভাবক নিজের প্রতিবন্ধী শিশুকে বিশেষ স্কুলে দিতে চাইতেন না। আলমগীর সেই অভিভাবকদের বোঝাতেন আর বলতেন প্রতিবন্ধী হওয়া প্রতিবন্ধকতা নয়।

আলমগীর হোসেন সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, গত ৭ বছরে সুখাতী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয় থেকে সেরিব্রাল পালসি (মস্তিষ্কের একধরনের স্নায়ুবিক রোগ) সমস্যার ৫ জন শিশু পরিবারের কাছে ফিরেছে স্বাভাবিক হয়ে। বর্তমানে আরও ২৩ জন অটিস্টিক শিশু রয়েছে সুস্থতার পথে। এর মধ্যে ১৭ জন শিশু স্বাভাবিক হয়ে মূলধারার বাচ্চাদের সঙ্গে স্কুলে পড়াশোনা করছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি থেকে ইতোমধ্যে ৭৫ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ও ২০০ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুকে সহায়ক উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি নিয়মিত সপ্তাহে দুইদিন প্রতিবন্ধী শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

আলমগীর হোসেন বলেন, প্রতিবন্ধী সন্তানদের পরম বন্ধু তাদের বাবা-মা। আমি অনেক কষ্ট করে আজ এ পর্যন্ত এসেছি। আমরা বিশেষ যত্ন ও মনিটরিং করার মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূল ধারায় নিয়ে যাচ্ছি। আমার ভবিষ্যৎ ইচ্ছা আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোর কিছুটা উন্নয়ন ঘটানো ও জায়গা বিস্তৃতি করা। পাশাপাশি বাচ্চাদের পরিবহনের জন্য একটি গাড়ির ব্যবস্থা করা। 

আলমগীর বলেন, বর্তমানে প্রতিষ্ঠান চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাদের স্কুলটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। প্রতিবন্ধী শিশুদের অভিভাবকদের দেওয়া ফি তে আর সমাজের কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীদের দানে কোনোমতে চলছে স্কুলটি। পাশাপাশি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ২০২০ সালে বিদ্যালয়টির স্বীকৃতির জন্য আবেদন করি।

‘শুরুতে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে বুলিংয়ের শিকার হতাম। লোকজন আমাকে পাগল বলে ডাকতো। এরপর আমি ৮৭ বার বাদ দিতে চেয়েছি। কিন্তু অবুঝ শিশুদের কথা ভেবে তা আর পারিনি। স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছি প্রথম শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলানটিয়ার পুরস্কার, এরপর সেরা সংগঠনের পুরস্কার পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ পেয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দেশসেরা পদক।’ 

আলমগীর হোসেন স্থানীয় সমাজ সেবা অফিস থেকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সামাজিক সেবা সংগঠনের নামে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে তার স্কুলের এই সেবামূলক কাজগুলো পরিচালনা করছেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে গত ৪ বছর ধরে ঝুলে আছে তার বিদ্যালয়টির স্বীকৃতির আবেদন। 

আলমগীর বলেন, ‘স্কুলটি পরিচালনা করতে প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। আয় হয় প্রায় ২২ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক, কর্মচারীসহ মোট ২৮ জন কর্মরত। কাউকে নিয়মিত বেতন দিতে পারছি না।’ প্রতিষ্ঠানটি আমার স্বপ্ন। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। আমার দরকার বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি এবং নিয়মিত অনুদান পাওয়ার নিশ্চয়তা। সব শর্ত মেনে আবেদন করা হলেও এখনো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি মেলেনি।’  

প্রতিবন্ধী নিয়ে কাজ করে দেশের সর্ববৃহৎ সংগঠন সুইড বাংলাদেশের সাংগঠনিক সচিব ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মো. ইউনুছ আলী বলেন, আমার জানা মতে প্রতিবন্ধীতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০১৯ অনুযায়ী সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কুড়িগ্রাম জেলা থেকে অ্যাকাডেমিক স্বীকৃতির জন্য প্রায় ৭০টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় অনলাইনে আবেদন করে। এর মধ্যে ৪০টি এনডিডি ভুক্ত ও অবশিষ্টগুলো নন এনডিডি ভুক্ত। এর মধ্যে নাগেশ্বরী উপজেলার সুখাতী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়টি অন্যতম। বিদ্যালয়টি অটিজম শিশুদের নিয়ে কাজ করে সুনাম অর্জন করেছে। উল্লিখিত বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে জেলায় মাত্র তিনটি বিদ্যালয় এমপিও ভুক্ত। 

জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রোকুনুল ইসলাম বলেন, সুখাতী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিজম বিদ্যালয়টি একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন নামে রেজিস্ট্রেশন করা আমাদের এখানে। তবে একরকম স্কুলের সংখ্যা জেলায় কতগুলো আছে আমার জানা নেই।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –