• সোমবার ০৬ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২২ ১৪৩১

  • || ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

সেদিন আসলে কী হয়েছিল কবি রাধাপদে`র সাথে?

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১০ অক্টোবর ২০২৩  

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ‘চারণকবি’ খ্যাত রাধাপদ রায়ের (৮০) ওপর হামলার ঘটনার বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গিয়েছে। হামলার ঘটনায় করা মামলায় প্রধান আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হামলার ঘটনায় জেলাসহ সারাদেশ জুড়ে শুরু হয় তীব্র প্রতিবাদ। সেদিন আসলে কবি রাধাপদ রায়ের সাথে কি হয়েছিল তা অনুসন্ধানের জন্য ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেছে বার্তা২৪.কম। 

এ ঘটনার আদ্যপান্ত জানতে ঘটনাস্থল নাগেশ্বরীর ভিতরবন্দের কচুয়ারপাড় ডুবুরির ব্রিজ এলাকায় গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলেছেন এই প্রতিনিধি। 

গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের কচুয়ারপাড় গ্রামের ডুবুরির ব্রিজের কাছে কবি রাধাপদ রায়ের ওপর হামলা করেন ওই গ্রামের রফিকুল নামে এক দিনমজুর। এতে পিঠে ও ঘাড়ে আঘাত পেয়ে ওই দিনই নাগেশ্বরী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। পরে কবির ছেলে যুগল রায় বাদী হয়ে অভিযুক্ত রফিকুল ও তার বড় ভাই কদুর রহমানকে আসামি করে নাগেশ্বরী থানায় মামলা করেন।

পূর্ব শত্রুতার জেরে এই হামলা বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। হামলার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদে সোচ্চার হন নেটিজেনরা। ‘পূর্বশত্রুতার জেরে’ সংঘটিত এ ঘটনাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘সংস্কৃতি বিরোধী’ হামলা হিসেবে প্রচার করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। রাজনৈতিক রঙ দিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ারও অপচেষ্টা হয়। পুলিশ ও প্রশাসনিক তৎপরতায় গত ৪ অক্টোবর পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন মূল অভিযুক্ত যুবক রফিকুল। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়।

হামলায় আহত রাধাপদ রায়ের দাবি, রফিকুল তাকে আকস্মিক বাঁশ দিয়ে আঘাত করেন। রফিকুলের বড় ভাই কদুর রহমানের সাথে ছয়মাস আগের দ্বন্দ্বের জেরে তারই ইন্ধনে রফিকুল এই হামলা করেছেন বলেও দাবি করেন তিনি।

এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পূর্ব শত্রুতার জেরে রাধাপদকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন রফিকুল। এরপর উভয়ের ধস্তাধস্তিতে শামুকের স্তুপে পড়ে আঘাত পান প্রবীণ এই পল্লিকবি। এ ঘটনায় সাম্প্রদায়িক কিংবা সাংস্কৃতিক কোনও বিরোধ দেখতে নারাজ এলাকাবাসী। সরেজমিন ডুবুরির ব্রিজ এলাকায় গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

এলাকাবাসী জানান, ঘটনার দিন সকালে অভিযুক্ত রফিকুল তার অপর সঙ্গী নুর মোহাম্মদ, নুরনবী ও নওশাদসহ ডুবুরির ব্রিজের কাছের বিলে মাছ ধরছিলেন। স্থানীয় আজিজুল ইসলামসহ আরও কয়েক যুবক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে কাঁকড়া কুড়াতে আসেন রাধাপদ রায় ও তার গ্রামবাসী সুবল চন্দ্র। রাধাপদ রফিকুলের মাছের পাতিল থেকে কাঁকড়া নিতে গেলে ঘটে বিপত্তি।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী জেলে নুরনবী বলেন, ‘সকালে রফিকুল আর আমার ভাতিজাসহ (নুর মোহাম্মদ) মাছ ধরি। তখন কাছুয়াদা (রাধাপদ) আসি কয়, হ্যা রে কাঁকড়া নাই রে? আমি কইলাম, দাদা আছে কাঁকড়া, এখনা দেরি কর। এসময় রফিকুল আসি কয়, মোর ভাইয়োক ডাঙাইস নাই? এলা আছসিস ক্যা? এই কথা কয়া একটা ধাক্কা দিছে। এসময় কৃষ্ণদা (রাধাপদ) রফিকুলের কলার ধরি ফেলাইল। তখন রফিকুল দাড়ি ধরি দাদাক গড্ডে (গর্তে) শামুকের ওপরা ফেলাইল। তখন হামরা (আমরা) যে পাঁচ সাতজন আইচলোং (আছিলাম), হামরা আগে যায়া ওমাক সরে দিলোং। তখন দাদা উঠি রফিকুলক সাও (অভিশাপ) দিতে দিতে বাড়ি গেইল (গেল)।’

রাধাপদের পিঠে আঘাতের চিহ্ন প্রশ্নে নুরনবী বলেন, ‘পিঠের মধ্যে শামুক দিয়া কাটা গেইছে (গেছে)। রফিকুল কোনও বাঁশ দিয়া ডাঙায় (আঘাত) নাই। এটাই বাঁশ আছিল না। একই বর্ণনা দেন আরেক জেলে ও প্রত্যক্ষদর্শী নুর মোহাম্মদ।

দুই তিন মিনিটের মধ্যে আকস্মিক এই ঘটনা ঘটে বলে জানান ঘটনাস্থলে থাকা যুবক আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কাঁকড়া নিব্যার (নিতে) গেইলে বড় ভাইয়ের সাথে দ্বন্দ্বের আক্রোশে রফিকুল কাকার দাড়ি ধরি ধাক্কা দেয়। দুইজনে রাস্তার নিচের শামুকের পালার (স্তুপ) ওপরে পড়ি যায়। উনি (রাধাপদ) খালি গায় থাকায় শামুক লাগি ওনার পিঠ কাটা গেইছে।’

ডুবুরির ব্রিজের ঠিক পশ্চিমে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখেছিলেন গৃহবধূ সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘দুইজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হইছে। মুরুব্বি শামুকের মধ্যে পড়ি যায়া ক্ষত হইছে। যেটা সত্য সেটাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা দুজনই আমাদের গ্রামবাসী। কেউ শত্রু না। কারও পক্ষ বিপক্ষ নাই। এখানে বাড়াবাড়ির কিছু নাই। সত্য ঘটনা সেটা কিছুই না, মিথ্যা নিয়া তোলপাড়।’

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার স্বাক্ষী সুবল চন্দ্র (৫০) বলেন, ‘আমি মারতে দেখি নাই। খালি দেখলাম ধস্তাধস্তি। মুরুব্বি মানুষের সাথে ওই অবস্থা দেখিয়া সবাই যায়া ওদেরকে ছাড়াছাড়ি করি দিছি। যা দেখি নাই তা বলতে পারবো না।’

এলাকাবাসী বলছেন, একজন বয়স্ক মানুষের গায়ে হাত দেওয়া ঠিক হয়নি। তবে বিষয়টা গ্রামে বসে ফয়সালা করা যেত।

রফিকুলের বড় বোন মাবিয়া খাতুন বলেন, ‘ছোট ভাই ভুল করছে। কদুর ওই জায়গায় আছিল না। পরে জানার পর রফিকুলক ধরি মারছে। মুরুব্বিক দেখার জন্য ফল নিয়া হাসপাতাল গেইছে। ছোট ভাইয়ের হয়া ক্ষমা চায়া ফয়সালা করার কথাও বলি আসছে। রফিকুল মাছ মারি খায়। বাড়িত বউ বাচ্চাগুলা কান্দিকাটি (কান্নাকাটি) করি আছে।’

এদিকে রফিকুলকে আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞসাবাদের বরাতে কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার (এসপি) আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রফিকুল দাবি করেছেন, ওই দিন তার মাছ রাখা পাতিল থেকে রাধাপদ রায় কাঁকড়া নেওয়ায় তিনি রাধাপদকে ধাক্কা দেন। এতে সেখানে থাকা বেশকিছু শামুকের ওপর পড়ে গিয়ে রাধাপদ আঘাত পান। তাকে বাঁশ দিয়ে আঘাত করার কথা রফিকুল অস্বীকার করেছেন।’

প্রত‌্যক্ষদর্শী‌দের বক্ত‌ব্যের বিষ‌য়ে রাধাপদ ব‌লেন, 'তারা মিথ‌্যা বল‌ছেন। আ‌মি কি তাহ‌লে মিথ‌্যা মামলা ক‌রে‌ছি? আমা‌কে বাঁশের লা‌ঠি দি‌য়ে দুই‌ তিনবার মার‌ছে। তারা সেটা দেখ‌লো না শুধু দা‌ড়ি ধরা দেখ‌লো!'

রাধাপদের দুই ছেলে মাধব রায় ও যুগল চন্দ্র বলেন,‘বাবা বলেছেন, তিনি কাঁকড়া কুড়াচ্ছিলেন। এসময় রফিকুল তাকে হঠাৎ করে বাঁশ দিয়ে মারতে থাকেন। পরে ধাক্কা দিলে তিনি শামুকের ওপর পড়েন।’ পূর্ব শত্রুতা থেকে রফিকুল এমনটা করেছেন বলেও দাবি করেন কবির এই দুই ছেলে।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –