• রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

নাগেশ্বরীতে গ্রামবাসীর নিজস্ব উদ্যোগে রাস্তা নির্মাণ 

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৪ মার্চ ২০২৪  

গ্রাম আছে, সেই গ্রামে ৫/৬হাজার মানুষ আছে, কিন্তু মুল ভূখন্ডের সাথে নেই কোন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। শুকনো মৌসুমে জমির আইল ধরে মানুষ হেঁটে পথ পাড়ি দিলেও বর্ষাকালে ও বন্যায় সেই সুযোগও রুদ্ধ হয়ে যায়। এমন একটি বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার বল্লভের খাস ইউনিয়নের চর কৃঞ্চপুর গ্রাম। বছরের পর বছর চরম কষ্ট আর দুর্ভোগের মধ্যে যাতায়াত করতে হয় তাদেরকে। সেই গ্রামের মানুষ এখন কারো মুখাপেক্ষি না হয়ে নিজেদের উদ্যোগে নিজেদের চাঁদার টাকায় রাস্তা তৈরীর কাজ শুরু করেছেন। তাদের এই ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ সাঁড়া ফেলেছে গোটা জেলা জুড়ে।

এই গ্রামের রাস্তা তৈরীর প্রথম উদ্যোক্তা খোকন ব্যাপারী জানান, দীর্ঘ ১৮বছর ধরে ঢাকায় চাকুরী করেছি। যখন একেবারেই গ্রামে ফিরে আসলাম। তখন অনুভব করলাম গ্রাম থেকে মুল সড়কে যেতে দেড় কিলোমিটার এলাকাব্যাপী রাস্তা না থাকায় গ্রামের মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে মেঠো পথটি পাড়ি দেন। বর্ষায় ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। অসুস্থ্য আর গর্ভবতী নারীরা সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেদেরকে সমর্পন করে দেন। এভাবেই চলছিল মানুষের দুর্ভোগের দিনরাত। এখানকার চাষীদের সবচেয়ে কষ্টের আর হতাশার জায়গা হলো সড়কপথ না থাকায় ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে তারা বছরের পর বছর। এসব খোকন ব্যাপারীকে ভীষণভাবে নাঁড়া দেয়। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন গ্রামবাসীর লাগানো ভুট্টা ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে একটি রেকর্ড করা রাস্তা রয়েছে। কিন্তু নদী ভাঙনের ফলে সেই রাস্তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। খোকন ব্যাপারী ইউনিয়ন পরিষদ ও ভূমি অফিসের সাথে যোগাযোগ করে সেই রাস্তা বের করার উদ্যোগ নেন। এই কাজে গ্রামের মানুষও সাঁড়া দিতে শুরু করেন। প্রথমে নিজের টাকায় রাস্তা তৈরীর কাজ শুরু করেন খোকন ব্যাপারী। এরপর পুরো গ্রামের মানুষ তার সাথে যোগ দেন। গ্রামের মানুষের ভালো এই উদ্যোগের সাথে যোগ দেন ইউনিয়ন চেয়ারম্যানও। ফলে পুরো গ্রামের মানুষ সামর্থ অনুযায়ী চাঁদা প্রদান করায় শুরু হয় চর কৃঞ্চপুর থেকে কুমেদপুর বাজার যাওয়ার দেড় কিলোমিটার নতুন রাস্তা নির্মানের কাজ। বর্তমানে এই কাজ চলমান থাকলেও অর্থের অভাবে কিছুটা আটকে আছে।

এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক মিয়া জানান, আমরা প্রথমে দফায় দফায় মিটিং করি। স্থানীয় লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করি। গ্রামের সবাই ভোগান্তির মধ্যে থাকায় সবাই এই কাজে সাঁড়া দেন। এরপর আমরা কুমেদপুর গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলি। কারণ কুমেদপুরের ৭০টি পরিবারের মানুষ আলাদা ইউনিয়নের বাসিন্দা। আমরা বল্লভের খাস ইউনিয়নের ভোটার, তারা কালিগঞ্জ ইউনিয়নের ভোটার। কালিগঞ্জের কুমেদপুর গ্রামে যাতায়াতের রাস্তা থাকলেও আমাদের গ্রামে যেতে কোন রাস্তা ছিল না। আমরা জমির আল ধরে বা জমির উপর দিয়ে পথ বের করে চলাচল করতাম।

এই গ্রামের মকবুল হোসেন জানান, গ্রামে ৩৮০টি খানা আছে। আমরা খানাগুলোকে বিভিন্নভাবে ভাগ করি। যারা নিম্নবৃত্ত তাদের জন্য আমরা ৫শ' টাকা চাঁদা নির্ধারণ করি, যাদের মোটর সাইকেল আছে তাদের জন্য ১ হাজার টাকা, যাদের ঘোড়ার গাড়ি আছে তাদের জন্য ২ হাজার টাকা, ব্যবসায়ীদের জন্য ১০ হাজার টাকা, গৃহস্ত পরিবারের জন্য ১৫ হাজার টাকা এভাবেই তালিকা করে বারবার বৈঠক করি। ইতিমধ্যে চেয়ারম্যান দিয়েছেন ৪০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই আমরা কাজ শুরু করেছি।

গ্রামবাসী আরো জানান, বর্ষা ও বন্যায় যাতে গ্রামের মানুষকে ভোগান্তিতে পরতে না হয় এজন্য বন্যা সীমার উপরে আমরা মাটি কাটার ব্যবস্থা করি। লোক মারফত অনেক সময় ক্ষেপন হওয়ায় আমরা ভেকু দিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি। প্রথমে জমির মধ্যদিয়ে ভেকু চালিয়ে গর্ত করে দুপাশে উঁচু করে দিয়েছি। পরে শ্যালো দিয়ে মাঝখানের মাটি ভরাট করছি। আশা করছি এই ডিসেম্বর মাসে আমরা নতুন পথ দিয়ে মুল সড়কে যেতে পারবো।

চর কৃঞ্চপুরের বাসিন্দা আব্দুল মান্নান তার অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে গিয়ে জানান, একটা কথাই আছে, মানুষ অনেক দু:খে যখন পরে তখন কিন্তু তারা বিষ খায় বা সুইসাইড করে। আমরা কিন্তু ওইটাই করেছি। কষ্টটা সহ্য করতে না পেরে মনে করছি একমাস বা দুইমাস না খেয়ে থাকবো তবু রাস্তা করবো। এই যে এত কষ্ট করে আমরা ভুট্টা আবাদ করেছি, কুমেদপুরে ভুট্টার যে দাম তার চেয়ে আমাদের গ্রামের মানুষ দেড়শ-দুশো টাকা কম দামে ভুট্টা বিক্রি করছি।

এই গ্রামের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিয়ামনি  ও জেসমিন জানায়,  গ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় মুল সড়কে যেতে আমাদেরকে প্রতিদিন ৩ কিলোমিটার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হচ্ছে। বন্যার সময় সেটা আর সম্ভব হয়না। ফলে বেশিরভাগ মেয়েকে বাল্যবিয়ের শিকার হতে হয়। রাস্তাটি যদি নির্মান হয় তাহলে আমাদের অভিভাবকরা পড়াশুনা করার সুযোগ দিবে। বাল্যবিয়ে থেকে আমরা রেহাই পাবো। এই গ্রামে সহযে অটোরিক্সা চলে আসবে। দূর হবে আমাদের কষ্ট।

এ গ্রামের গৃহিনী ময়না বিবি জানান, গত বছর গর্ভবতী অবস্থায় খেউনী গাজীর ভাগ্নি চিকিৎসা বিনে মারা গেছে। চারদিকে পানি থাকায় তাকে শহরে নিয়ে যাওয়ার কোন ব্যবস্থাই ছিল না। এভাবে এই গ্রামের অনেক মানুষ সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে অকালে মারা গেছে। রাস্তাটি হলে আমাদের সব ধরণের দুর্ভোগ থেকে আমরা রেহাই পাবো।

 বল্লভের খাস ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস.এম আব্দুর রাজ্জাক জানান, আমার ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডটি একটি ছোট্ট শাখা নালা দ্বারা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। এরফলে ৫ থেকে ৬ হাজার মানুষের যাতায়াত, তাদের উৎপাদিত পণ্যাদির মূল্য তারা সঠিকভাবে পায় না। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই সমস্যায় ভুগছেন। এখানে একটি রেকর্ডি রাস্তা থাকলেও বন্যা ও নদী ভাঙনের ফলে ৮০'র দশকে রাস্তাটি বিলিন হয়ে গেছে। আমাদের ইউনিয়নে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় আমরা সেখানে কোন কাজ করতে পারি নি। তারা নিজ অর্থে রাস্তার কাজ শুরু করার উদ্যোগ নিলে আমিও সেখানে যোগ দেই। বর্তমানে আমরা যৌথভাবে সকলকে সাথে নিয়ে কাজটি চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি ডিসেম্বর মাসে কাজটি শেষ করতে সক্ষম হবো।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে নতুন রাস্তা তৈরী করা হচ্ছে। এটি একটি ভালো দৃষ্টান্ত। অনেকে এটি দেখে উদ্বুদ্ধ হবে। সেই জায়গায় সরকারিভাবে যে সহায়তা প্রয়োজন সেটুকু জেলা প্রশাসন করবে। এই উদ্যোগটি যাতে আরো অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে যায় সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণ যাতে এ ধরণের উদ্যোগ বেশি করে গ্রহন করে সেটি আমরা প্রত্যাশা করবো এবং সকলকে আহবান জানাবো সাথে থাকবার জন্য। আর আমরা তো সব সময় জনকল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –