• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

ভুরুঙ্গামারীতে দেখা মিলেছে গল্পের সেই আদু ভাইয়ের!

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩  

কুড়িগ্রামে দেখা মিলেছে গল্পের সেই আদু ভাইয়ের। তবে তার নাম মো. দুলু মিয়া (৩৫)। তিনি ভুরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের দিয়াডাঙা গ্রামের বাসিন্দা। তবে তিনি থাকেন ভুরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের তালুক মশাল গ্রামের একটি কবরস্থানে। অন্যের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করলেও গাছপালা বেষ্টিত কবরস্থানই তার পছন্দের জায়গা। রাতে সেখানেই ঘুমান, সকাল হলে পড়াশোনা করতে ছোটেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

জানা গেছে, মা মারা যাওয়ার পর দুলু মিয়া ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ওই কবরস্থানে। মাঝে মধ্যে স্বজনা তাকে বাসায় নিয়ে গেলেও কবরস্থানে নিজের তৈরি কাঠের বাক্স, একটি বালিশ আর বেড়াবিহীন টিনের চালই তার পছন্দ। পড়াশোনায় বেশ আগ্রহ। হাতের লেখাও ভালো। তবে পড়াশোনায় উন্নতি নেই তার। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে আছেন দুলু মিয়া।

দুলু মিয়া বছরের পর বছর লেখাপড়া করতে ছুটে চলেছেন বিদ্যালয়ে। তবে এক স্কুলে পড়াশোনা করে মন ভরে না তার। এলাকা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী কিংবা দূরে ৩-৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনিবন্ধিত ছাত্র তিনি। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে সবকটি স্কুলে একই (দ্বিতীয়) শ্রেণিতে পড়েন তিনি।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছেন দুলু মিয়া। তাকে নিয়ে নানান ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। তার বাবা-মা ও স্বজন নেই বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হলেও আদতে সেগুলো সবই গুজব।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুলু মিয়ার মা-বাবা দু’জনই ছিলেন। তারা মারা গেছেন। তার বাবার নাম মৃত মালু মিয়া। দুলু মিয়ার দুই ভাই ও দুই বোন রয়েছেন। দিয়াডাঙা গ্রামে ছিল তার স্থায়ী বাস। বাবার মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পদ ছিল ৪ বিঘা জমি আর বসতবাড়ি। বর্তমানে সেখানে বসবাস করেন তার ছোট ভাই বেলাল মিয়া। দু’বোনের বিয়ে হয়েছে।

দুলু মিয়া বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হওয়ায় বাবা মারা যাওয়ার আগেই জমি লিখে নিয়েছেন বড় ভাই। মা মারা যাওয়ার পর হঠাৎ তিনি ঘরছাড়া হন। আশ্রয় নেন তালুক মসাল পাড়া গ্রামের রঞ্জু মিয়ার পারিবারিক একটি কবরস্থানে। ঝড়, বৃষ্টি, শীত কিংবা গরমে ওই কবরস্থানে আলোবিহীন জঙ্গলে বসবাস করেন তিনি। তার সম্বল বলতে নিজের তৈরি বেড়াবিহীন চার টিনের চাল, স্কুলে যাওয়ার জন্য নিজের তৈরি ছোট তিন চাকার গাড়ি ও একটি কাঠের বাক্স। ওই বাক্সে কাপড়, বই-খাতা ও কলম তালাবদ্ধ করে রেখে বাক্সের ওপর ঘুমান তিনি। স্কুলে যাওয়ার জন্য নিজেই তৈরি করেছেন টায়ারবিহীন ভ্যান আকৃতির প্রাইভেট গাড়ি।

অনেকের কাছে তার জীবনযাপন কষ্টকর মনে হলেও কেউ কেউ দুলু মিয়াকে সুখি মানুষ হিসেবে জানেন। কেউ খেতে দিলে খান। খাবার না পেলে কবরস্থানেই ঘুমান। তবে প্রায় সময় স্থানীয় মো. রঞ্জু মিয়া ও আশরাফুল ইসলাম নামের দুই ব্যক্তির বাড়িতে খেয়ে চলে তার জীবন।

দুলু মিয়ার একটাই কাজ, বিদ্যালয়ে ছুটে চলা। নিজের তৈরি সাইকেল নিয়ে বছরের পর বছর লেখাপড়া করতে ছুটে যান স্কুলে। তার রুটিনে সরকারি ছুটি কিংবা বন্ধের দিন বলতে কোনো শব্দ নেই।

প্রতিবন্ধী হলেও তার বিরুদ্ধে সহপাঠী, শিক্ষক কিংবা অভিভাবক কারো কোনো অভিযোগ নেই। শান্ত দুলু মিয়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে বছরের পর বছর পড়ে আসছেন। শিক্ষা জীবনের প্রায় ২৫ বছর পার করলেও একই ক্লাসে থাকার বিরল ঘটনায় হতবাক মানুষজন। কেউ বলছেন এক সময় বিস্কিট খাওয়ার লোভে দুলু মিয়া স্কুলে যাওয়া শুরু করেন যা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

তালুক মসাল পাড়া গ্রামের মো. রঞ্জু মিয়া বলেন, আমি জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি, দুলু মিয়ার মতো এমন মানুষ দেখিনি। কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে একই ক্লাসে আছে। তার সহপাঠীরা বিভিন্ন জায়গায় চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। আর দুলু মিয়া পড়ে আছে একই ক্লাসে। সে প্রতিদিনই নিজের বানানো দুই চাকার ছোট গাড়ি নিয়ে স্কুলে যায়। স্কুল খোলা কিংবা বন্ধের দিন বলতে তার কাছে কিছু নেই। প্রতিদিনই স্কুলে যায় সে।

দুলু মিয়ার ভাই বেলাল মিয়া বলেন, দুলু ভাই কানে কম শোনেন। তার বুদ্ধি কম, তবে ছোটকাল থেকে পড়াশোনা করার আগ্রহ খুব বেশি। বাড়িতে না থেকে তিনি কবরস্থানে থাকেন, আমরা কী করবো। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে হয়তো তিনি ভালো হতেন।

দিয়াডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোছা. হালিমা খাতুন বলেন, দুলু মিয়া সময়মতো স্কুলে আসেন। স্কুলের বারান্দায় ময়লা, খড়কুটো দেখলে অফিস রুমে ঢুকে ঝাড়ু নিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করেন। নিজেকে খুব পরিপাটি রাখতে পছন্দ করেন তিনি। বেঞ্চ কিংবা মাঠে কোনো ময়লা থাকলে তিনি পরিষ্কার করেন। কানে একদম কম শোনেন। তবে লিখতে পারেন, কোনো কিছু বলতে পারেন না।

তিনি আরও বলেন, দুলু মিয়ার স্কুলের হাজিরা খাতায় নাম নেই। তবে অনেক বছর ধরে একই (দ্বিতীয়) শ্রেণির বই নিয়ে স্কুল যাওয়া আসা করছেন। ছেলে-মেয়েদের কারো সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করেন না। প্রায় ২৫ বছর ধরে একই ক্লাসে পড়ে আছেন দুলু মিয়া।

পাথরডুবি ইউপি চেয়ারম্যান মো. আব্দুস সবুর বলেন, আমার ইউনিয়নের ৪নং তালুক মসাল পাড়া গ্রামে থাকেন দুলু মিয়া। তিনি প্রতিদিনই স্কুলে যান। তার নামে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা পেলে তার বসবাসের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখবো।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –