• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

শেখ হাসিনাই পাহাড়ে উড়িয়েছেন শান্তির পতাকা  

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২ ডিসেম্বর ২০২২  

শেখ হাসিনাই পাহাড়ে উড়িয়েছেন শান্তির পতাকা                          
২ ডিসেম্বর শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি অনন্য দিন। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদে এক বছরের কিছু সময় পরই এসেছিল ঐতিহাসিক সেই মহেন্দ্রক্ষণ। দুই দশকেরও বেশি সময়ে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে চলছিল রক্তের হোলি খেলা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিমির (জেএসএস) মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন হলে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের কাছে শান্তির পরিবেশ তৈরি হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন কোন পিছিয়ে পড়া জনপদ নয়। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় তারাও সমান অংশীদার। শেখ হাসিনাই পাহাড়ে উড়িয়েছেন শান্তির পতাকা। তিনি ছিলেন বলেই শান্তি চুক্তি হয়েছিল। এখন সেখানে পাহাড়ি ও বাঙালিরা সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইল ফলক অধ্যায় হয়ে চিরস্মরণীয় থাকবে 

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তৎকালীন চীফ হুইপ আলহ্বাজ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও শান্তিরক্ষী বাহিনীর পক্ষে তাদের শীর্ষ নেতা সন্তু লারমা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়া চুক্তিটি ঐতিহাসিক, এক কথায় বিরল একটি ঘটনাও বটে। শান্তি চুক্তি হওয়ার পর ১৯৯৮ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে শান্তিরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ গেরিলা নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি পরিষদের প্রায় দুই হাজার সদস্য অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। তখন থেকেই পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ পায়। সেসময় থেকেই সেখানে শান্তির সুবাতাস বিরাজ করছে।

ষাটের দশকে পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই হ্রদ তৈরি হলে এ অঞ্চলের প্রায় ১ লক্ষ লোক গৃহহারা হয়। পাকিস্তান সরকার গৃহহীনদের তেমন কোন ক্ষতিপূরণ তো দেয়নি এমন কি তাদের আশ্রয়ের কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে সেখানকার উপজাতি সম্প্রদায় গুলোর মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ক্ষোভ, হতাশা থেকে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। তৈরি হয় একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ। যাদের অত্যাচারে নিরীহ বাঙালিদের জীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠে, এমন কি নির্যাতনের শিকার থেকে পাহাড়িরাও বাদ যায়নি।

১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সময়ে পাহাড়ি জনগণের নেতৃত্বে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি পরিষদ' নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গঠিত হয়। পরবর্তীতে শান্তিরক্ষী বাহিনী নামে একটি সামরিক শাখা যোগ হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জনসংহতি পরিষদের নেতৃবৃন্দ ভারতে চলে যায়। সামরিক দিক দিয়ে তারা শক্তিশালী হতে থাকে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়াগাড়ির উপর হামলা চালায়। তারপর থেকে ওই অঞ্চলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। অঞ্চলটিকে ২৪ তম ডিভিশনের জিওসির অধীনে আনা হয়।

জিয়া-এরশাদ শাসকদের আমলে বিপুল সংখ্যক সমতল অঞ্চলের ভূমিহীন, দিনমজুর, অসহায় দুস্থ লোকজনকে সরকারি খাস জমিতে পুনর্বাসন করে কার্যত পাহাড়কে আরো অশান্ত করে তোলে। সন্ত্রাসের জনপথ হয়ে ওঠে পাহাড়। সরকারের উপর প্রতিশোধ নিতে প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের শান্তিরক্ষী বাহিনী রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠে। নৈসর্গিক লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অন্ধকার অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত সিন্ধান্তে পার্বত্য শান্তি চুক্তির কারণে সেখানে দীর্ঘদিনের জাতিগত হানাহানি বন্ধ হয়। সেসময় এই চুক্তি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ছিল একটি বিরল ঘটনা। এজন্য তিনি পেয়েছিলেন ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার।

চুক্তির শর্তানুসারে ১৯৯৮ সালে ৩ মে প্রতিষ্ঠা করা হয় স্থানীয় সরকার পরিষদ। গঠিত হয় পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়,পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। ভারত থেকে জুম্ম শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তারপর থেকে চলছে উন্নয়নের এক মহাযজ্ঞ। চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্য দিয়ে ৪৮ টি পূর্ণাঙ্গ,১৫ টি আংশিক ও ৯টি ধারা প্রক্রিয়াধীন আছে।‘তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ' এবং নিয়ন্ত্রাধীন ৩৩ টি দপ্তর ও সংস্থার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৩০ টি, খাগড়াছড়িতে ৩০ টি এবং বান্দরবানে ২৮ টি হস্তান্তর করা হয়েছে। আত্মসমর্পণকৃত সদস্যদের পুনর্বাসনসহ পুলিশ ও আনসারে ৬৮৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। একটি পদাধিক বিগ্রেডসহ ২৩৮ টি নিরাপত্তা বাহিনী ক্যাম্প প্রত্যাহার, সংসদ উপনেতার নেতৃত্বে তিন সদস্যের চুক্তি বাস্তবায়নের মনিটরিং কমিটি গঠন,পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন,ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সাংস্কুতিক প্রতিষ্ঠান বিল-২০১০সংসদে পাস, তিন জেলাতেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে নৃ-গোষ্ঠিদের জন্য কোটা সংরক্ষণ সহ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অভূত উন্নতি করা হয়।

স্বাধীনতার আগে যেখানে মাত্র ৪১ কি.মি এবং শান্তি চুক্তির পূর্বে ২০০ কি.মি সড়ক ছিল সেখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে দেড় হাজার কি.মির বেশি সড়ক তৈরি হয়েছে। রুমা ও ধানচি উপজেলার সাঙ্গু নদীর উপর নির্মিত হয়েছে সেতু। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দুর্গম এলাকায় এসব রাস্তা, ব্রিজ ও কালভাট নির্মাণ করেছে, এখনও করে যাচ্ছে।

টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন,স্বাস্থ্য,বিদ্যুৎ,অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। পাহাড়ি জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নে রাঙ্গামাটিতে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পার্বত্য জেলার বেশ কিছু এলাকাকে পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে,যা দেশী বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণে পরিণত হয়েছে।

কেবলমাত্র ভূমি সংস্কার ব্যতীত পার্বত্য শান্তি চুক্তির অধিকাংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী চার অঞ্চলে চারটি সেনা বিগ্রেড ছাড়া অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছ। তিনটি স্থলবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে।
আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে। বিএনপি,জামায়াতসহ মৌলবাদী দল গুলোর সেখানে তেমন কোন জন ভিত্তি নেই,কেবলমাত্র বহিরাগত বাঙালিদের মধ্যে কিছু সমর্থন আছে। তারা সেসময় যেমন শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করেছিল, এখনও পাহাড়কে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির জন্য সন্ত্রাসী গ্রুপ গুলোকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন কোন পিছিয়ে পড়া জনপদ নয়। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় তারাও সমান অংশীদার। শেখ হাসিনাই পাহাড়ে উড়িয়েছেন শান্তির পতাকা। তিনি ছিলেন বলেই শান্তি চুক্তি হয়েছিল। এখন সেখানে পাহাড়ি ও বাঙালিরা সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইল ফলক অধ্যায় হয়ে চিরস্মরণীয় থাকবে।

লেখক : তাপস হালদার 
সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –