• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ফসলের জমির ইঁদুর দমন করতে পলিথিনের ঝান্ডা! 

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১ অক্টোবর ২০২১  

বিষটোপ, গ্যাস ট্যাবলেট, গর্তে পানি ঢেলে এবং বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করে কৃষকরা ফসলের জমির ইঁদুর দমন করে থাকে। অতি প্রচলিত এসব পদ্ধতি ব্যবহারে কিছুটা আর্থিক খরচ হয় এবং নিয়মিত তদারকি করতে হয় কৃষকদের।

সবসময় এসব পদ্ধতি সঠিকভাবে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থান বিবেচনায় কাজও করে না ফসলের জমিতে। তাই বিনা খরচে পলিথিন দিয়ে ঝান্ডা তৈরি করে ইঁদুর তাড়ানোর নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করছে কৃষকরা। এতে সফলতাও মিলছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ওপরে ফসলের ক্ষতি করে ইঁদুর।

ধানের জমিতে ইঁদুর শীষ আসার আগেও গাছ কেটে দেয় এতে ওই গাছে আর ফলন হয় না। এছাড়াও ধান পেকে গেলেও ইঁদুর শীষ কেটে নিয়ে যায়।এতে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পরে কৃষক।

সম্প্রতি মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের আমন ধানের বিস্তৃত ফসলের মাঠের কয়েকটি জমিতে সাড়ি সাড়ি খুঁটির সাথে লম্বা চারকোনাকৃতির পলিথিন শিট দিয়ে ঝান্ডা পুঁতে রাখা হয়েছে।দৃশ্যটি দেখে কৌতূহল হওয়ায় সংশ্লিষ্ট গ্রামের কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে জমিতে ইঁদুরের উৎপাত বেড়েছে তাই এভাবে খুঁটির সাথে পলিথিন বেঁধে দেওয়া হয়েছে ইঁদুর তাড়ানোর জন্য।

বাতাস বইলে এসব পলিথিন উড়তে থাকে এবং মৃদু শব্দ হয়। এই শব্দে জমিতে ইঁদুর থাকলে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। কোন খরচ নেই এই পদ্ধতি ব্যবহারে। বাড়িতে থাকা পলিথিনের শপিং ব্যাগ অথবা শিট লম্বা করে কেটে জমির বিভিন্ন জায়গায় খুঁটির মাথায় সুতো দিয়ে বেঁধে জমিতে পুঁতে রাখলেই হয়ে যায়। এভাবে ঝান্ডা পদ্ধতিতে জমি থেকে প্রাকৃতিকভাবে ইঁদুর তাড়ানোর যায়।

কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আমন ধানের জমিতে পানি থাকায় ইঁদুরের গর্ত খুঁজে পাওয়া যায় না এবং গ্যাস ট্যাবলেট, ক্যেচিকল ও ফাঁদ ব্যবহার করতেও অসুবিধা হয়। সেজন্য ছোট ছোট খুঁটির উপরিভাগে পলিথিন বেঁধে ঝান্ডা তৈরি করে জমির বিভিন্ন জায়গায় পুঁতে রাখলে বাতাসের শব্দে পলিথিন উড়তে থাকে এবং শব্দ হওয়ার কারণে ইঁদুর পালিয়ে যায়।

এই পদ্ধতির কার্যকারিতা কেমন জানতে চাইলে কৃষক মোস্তফা বলেন, এটা করতে কোন খরচ হয় না সেজন্য আমরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করি ১০০ ভাগ কাজ না হলেও এটা ব্যবহার করলে জমিতে ইঁদুরের অত্যচার কমে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, সরকারি বেসরকারিসহ বিভিন্ন খাদ্যগুদাম, পাউরুটি, কেক ও বিস্কুট তৈরির কারখানা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা বিভিন্ন খাদ্য পণ্য, তৈরি পোশাক, বিক্রির দোকানেও ইঁদুর ব্যাপক পরিমাণ পণ্য সামগ্রী নষ্ট করে। এর কোন সঠিক বা অনুমান ভিত্তিক সরকারি হিসেব না থাকায় টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হয় না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশে ইঁদুরের কারণে বছরে গম ৪ থেকে ১২ ভাগ, আমন ধানের শতকরা ৫ থেকে ৭ ভাগ, আলু ৫ থেকে ৭ ভাগ, আনারস ৬ থেকে ৯ ভাগ নষ্ট হয়। প্রতিবছর শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ সেচনালা নষ্ট হয় ইঁদুরের কারণে।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডি এর বিশ্বব্যাপী ইঁদুরের উপদ্রপ নিয়ে করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রুত এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা। এরমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখানকার উপকূলীয় লোনা ও মিঠা পানির মিশ্রণের এলাকাগুলো ইঁদুরের বংশবিস্তারের জন্য ভালো। ফসলের মাঠ ছাড়াও এসব অববাহিকার হাট বাজার ও শিল্পাঞ্চলেও ইঁদুরের উপস্থিত বেশি।

আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ ধান ও গম ইঁদুর খেয়ে ফেলে এবং নষ্ট করে। ইরি'র আরেকটি গবেষণায়, ফসলের মোট ক্ষতির বিবেচনায় ইঁদুরের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ফিলিপাইন দেশটির উৎপাদিত ধানের ২০ শতাংশ ইঁদুর খেয়ে ফেলে ও নষ্ট করে। এরপরেই লাওস এর অবস্থান। দেশটির প্রায় ১৫ শতাংশ ধান ইঁদুরের পেটে যায়।

ইরির আরকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, এশিয়া মহাদেশে ইঁদুর বছরে যে পরিমাণ ধান, চাল খেয়ে নষ্ট করে তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। শুধু বাংলাদেশেই ইঁদুর প্রায় ৫০ থেকে ৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। এশিয়া মহাদেশে বছরে ১৮ কোটি মানুষের ১২ মাসের খাবার নষ্ট করে ইঁদুর।

ইঁদুর জাতীয় প্রাণি যেমন কাঠবিড়ালি, সজারু, ইঁদুর এদের স্বভাগত বৈশিষ্ট্য দাত দিয়ে প্রায় সবসময় কাটাকাটি করা। এদের দাঁত দ্রুত বড় হয় তাই দাঁতের আকার ছোট রাখতেই নিয়মিত কাটাকুটি করতে হয়। ইঁদুর যে পরিমাণ খাবার খায় তার চেয়ে প্রায় ১০ গুন বেশি নষ্ট করে।

ধান,গম, ভুট্টা, বাদাম, নারকেল, পেয়ারা, লিচু, আম, সফেদা, লাউ, শাকসবজি সহ মাটির নিচের ফসল, আলু, মূলা, গাজর, ওলকপিও রেহাই পায় না ইঁদুরের আক্রমণ থেকে। ধান ও গমের শীষ আসলে এরা ৪৫ ডিগ্রি কোনাকুনি ভাবে কেটে গর্তে সংরক্ষণ করে সারাবছরের খাবারের যোগানের জন্য।

দেশে ১৮ প্রজাতির ইঁদুর রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে মাঠের কালো ইঁদুর। এরা ১৫০ গ্রাম ওজনের হয়।গড়ে একেকটি ইঁদুর ৩ বছর পর্যন্ত বাঁচাতে পারে। এরা প্রতি মাসেই বাচ্চা দেয় এবং ৬ থেকে ৮টি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করে প্রতিবার। বাচ্চা হওয়ার দুই দিন পরে আবারও গর্ভধারন করতে পারে ইঁদুর।

রাজীবপুর উপজেলা কৃষি অফিসার রফিকুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ইঁদুর নোংরা ও বদ্ধ স্থান পছন্দ করে। ফসলের মাঠ, বাঁধ, বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থান পরিষ্কার রাখলে এর বংশবৃদ্ধি কমে আসবে।

এছাড়াও প্রচলিত ফাঁদ পেতেও ইঁদুর দমন করা যায়।কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে প্রতি বছর কৃষকদের সহায়তায় উপজেলার লক্ষাধিক ইঁদুর মারা হয় বলেও জানিয়েছেন তিনি। প্রতি বছর কৃষি বিভাগের উদ্যোগে সারাদেশে যে পরিমাণ ইঁদুর দমন করা হয় তাতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ফসল সুরক্ষিত হয়।

জমিতে পলিথিনের ঝান্ডা উড়িয়ে ইঁদুর দমনের বিষয়ে তিনি বলেন, এই পদ্ধতি গত কয়েক বছর থেকে কৃষকরা ব্যবহার করছে এতে তারা উপকৃত হচ্ছে। বাতাসে পলিথিন উড়তে থাকলে একটু শব্দ হয় তখন ইঁদুর ভয়ে পালিয়ে যায় জমি থেকে।

প্রতিবছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানের আয়োজন করা হয়। মাসব্যাপী আয়োজিত এই অভিযানে দেশের সবচেয়ে বেশি ইঁদুর নিধনকারী কৃষককে পুরষ্কার প্রদান করা হয়।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –