• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুসলিম স্থাপত্যের প্রতীক নীলফামারীর ‘চিনি মসজিদ’

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৩ মার্চ ২০২৪  

নীলফামারীর সৈয়দপুর বাংলাদেশের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে একটি। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই শহরটি অনেক আগে থেকেই প্রসিদ্ধ হলেও অনেকের কাছে সৈয়দপুর ‘রেলের শহর’ বলে বেশি খ্যাত। এই শহরের প্রাচীন সৌন্দর্যের স্থাপত্য নিদর্শন হচ্ছে সৈয়দপুরের ‘চিনি মসজিদ’।  

তবে দর্শনার্থীরা মুগ্ধকর পরিবেশ ও অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে প্রাণ জুড়াতে ছুটে  আসেন সৈয়দপুরের গোলারহাটের অবস্থিত এই চিনি মসজিদটি দেখতে।

চিনি মসজিদ। নাম শুনে মনে হতে পারে মসজিদটি চীনাদের তৈরি কিংবা এর নির্মাণের পেছনে চীনাদের কোনো অবদান আছে। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। মূলত পুরো মসজিদে রঙিন উজ্জ্বল চীনা মাটির পাথরের টুকরো দ্বারা চিনির দানার মতো নিখুঁত কাজ করা হয়েছে। এ কারণে মুসলিম স্থাপত্যের এই মসজিদটি ‘চিনি মসজিদ’নামে পরিচিত।

জানা গেছে ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে যে কয়টি মসজিদ রয়েছে চিনি মসজিদ তার মধ্যে অন্যতম। শৈল্পিক কারুকাজ ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য হিসেবে চিনি মসজিদের রয়েছে বিশেষ খ্যাতি। নীলফামারী জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সৈয়দপুর শহরের ইসলামাবাদ এটি অবস্থিত। প্রতি শুক্রবার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মসজিদে আসেন জুমার নামাজ আদায় করতে।

ঐতিহাসিক এই মসজিদ নির্মাণের প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস বেশ সুদীর্ঘ। ১৮৬৩ সালে হাজী বাকের আলী ও হাজী মুকু নামে দুই ব্যক্তি সৈয়দপুরের ইসলামবাগ এলাকায় ছন ও বাঁশ দিয়ে প্রথম এই মসজিদ নির্মাণ করেন। স্থানীয়দের সহযোগিতায় এটি টিনে রূপান্তরিত হয়। এরপর তারা একটি তহবিল গঠন করেন। এরপর শুরু হয় মসজিদের নির্মাণ কাজ।

জনশ্রুতি রয়েছে, শঙ্কু নামে জনৈক হিন্দু মিস্ত্রি দৈনিক ১০ আনা মজুরিতে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। স্থানীয় এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তাকে সাহায্য করতে থাকে। এতে ব্যয় হয় ৯ হাজার ৯৯৯ রুপি ১০ আনা। ঐতিহাসিক এই মসজিদের স্থপতি হিসেবে মো. মকতুল এবং নবী বক্স নামে দুইজনের নামও শোনা গেছে।

মসজিদের সৌন্দর্য বাড়াতে দেয়ালে চিনামাটির থালার ও কাঁচের ভগ্নাংশ বসানো হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘চিনি করা’ বা ‘চিনি দানার কাজ করা’। ধারণা করা হয়, এখান থেকেই এর নামকরণ হয় চিনি মসজিদ। আবার কেউ কেউ বলেন, পুরো মসজিদটিতে চীনা মাটির কাজ বলে একে চীনা মসজিদও বলা হতো। কালক্রমে চীনা মসজিদ থেকে এর নাম চিনি মসজিদ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে মসজিদের পরিধি বাড়তে থাকে।

১৯২০ সালে হাজী হাফিজ আবদুল করিমের উদ্যোগে ৩৯ ফুট বাই ৪০ ফুট আয়তনবিশিষ্ট মসজিদটির প্রথম অংশ পাকা করা হয়। হাজী আবদুল করিম নিজেই মসজিদটির নকশা এঁকেছিলেন। পুনরায় ১৯৬৫ সালে মসজিদের দক্ষিণ দিকে ২৫ বাই ৪০ ফুট আয়তনবিশিষ্ট দ্বিতীয় অংশ পাকা করা হয়। সম্প্রতি এর আয়তন আরো বাড়ানো হয়েছে। 

১৯৬৫ সালে বগুড়ার একটি গ্লাস ফ্যাক্টরি চিনি মসজিদের জন্য প্রায় ২৫ টনের মতো চীনা মাটির পাথর দান করে। এগুলো দিয়ে মোড়ানো হয় মসজিদের মিনারসহ বড় তিনটি গম্বুজ। এর মূল অংশের বর্ণ অনেকটা লালচে হলেও একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, পরবর্তী সময়ে তৈরি করা অংশ অনেকটা সাদা বর্ণের। এ ছাড়া সেই সময় কলকাতা থেকেও ২৪৩ খানা শংকর মর্মর পাথর এনে লাগানো হয় এই মসজিদে।

মসজিদের মুয়াজ্জিন আরিফ হোসেন বলেন, আমাদের ইসলামবাগ চিনি মসজিদের আনুমানিক বয়স হয়ে গেছে ১৬৩ বছর । আমাদের মসজিদের অনেক সংস্কার প্রয়োজন। চিনি মসজিদের যে ৪৮টি মিনার ও ৪টি গম্বুজ রয়েছে এগুলো অনেক বেশি পুরাতন হয়ে যাওয়ায় এখন ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে অনেক জায়গায়। এগুলো সংস্কারের জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। আর আমাদের এই মসজিদটি দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক মানুষজন আসে দেখতে ও নামাজ পড়তে।

দিনাজপুর  থেকে দেখতে আসা শহিদুল  ইসলাম নামের এক দর্শনার্থী বলেন, আমি অনলাইনে এই মসজিদটির ভিডিও দেখেছি। এরপর  সিদ্ধান্ত নেই মসজিদটি দেখার জন্য। আমি আমার এক বন্ধুসহ এখানে আসছি। এসে দেখলাম অসাধারণ সব কারুকাজ। অনেক সুন্দর নকশাগুলো সব মিলেই অসাধারণ। কিন্তু মসজিদটির সামনে বা পেছনে কোনো জায়গা নেই। বেশি মুসল্লী হলে নাকি রাস্তায় নামাজ আদায় করতে হয় এই বিষয়টি শুনে খুব খারাপ লাগলো।

স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল রানা বলেন, এই মসজিদটি তিন আমলে তৈরি করা হয়েছে। প্রথমে ব্রিটিশ মাঝখানের অংশ যেটা এটা ব্রিটিশ আমলের। বামদিকের যে অংশটি রয়েছে সেটি পাকিস্থান আমলের। আর ডানদিকের অংশটি রয়েছে যা দেখলে একদম নতুন বোঝা যায় সেটি হচ্ছে আমাদের আমলের।  

মসজিদের দেয়ালে অঙ্কিত ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপ ফুল, একটি বৃত্তে একটি ফুল, চাঁদতারাসহ নানা চিত্র রয়েছে। এতে রয়েছে ২৭টি বড় মিনার, ৩২টি ছোট মিনার ও তিনটি বড় গম্বুজ। মসজিদে একসঙ্গে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক নামাজ আদায় করতে পারেন। এই মসজিদে রয়েছে উত্তর ও দক্ষিণে দুটি ফটক। মসজিদের গোটা অবয়ব রঙিন চকচকে পাথরে মোড়ানো। আর বারান্দা বাঁধানো হয়েছে সাদা মোজাইকে। 

মসজিদের ইমাম সেলিম জানান, দীর্ঘদিন ৭ বছর ধরে এ মসজিদে নামাজ পড়াচ্ছি। এখানে একসঙ্গে প্রায় পাঁচ শতাধিক মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পড়তে পারেন। এখানে দূর দূরান্ত থেকে পর্যটক আসেন। এখানে মসজিদের দোতলায় একটি ভবনসহ পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। বাকি কাজ গুলো সংস্কার করলে আমাদের মসজিদটি আরো দৃষ্টিনন্দন হবে বলে তিনি দাবি করেন। 

জেলা প্রশাসক পঙ্কজ কুমার ঘোষ বলেন, সৈয়দপুরের ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নান্দনিক মসজিদটি আমাদের প্রাচীন নিদর্শন। যা আমাদের নজরে আছে মসজিদটি সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও সংস্কার কাজের জন্য বরাদ্দ আসলে দেওয়া হবে।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –