• রোববার ১২ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৯ ১৪৩১

  • || ০৩ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দেশের প্রথম টানেল প্রস্তুত: টানেলের যুগে বাংলাদেশ

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ১০ অক্টোবর ২০২২  

দেশের প্রথম টানেল প্রস্তুত: টানেলের যুগে বাংলাদেশ                      
ওপরে নদী। নিচ দিয়ে বছরে ছুটে চলবে ৭৬ লাখ গাড়ি! 'ওয়ান সিটি টু টাউন' স্লোগান নিয়ে এমন স্বপ্নের যাত্রার শুরু এক যুগ আগে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নামের এই 'স্বপ্নের দৈর্ঘ্য' ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। তবে এর সুফল পাবে পুরো দেশ। এটি দেশের অর্থনীতিকেও দেবে নতুন রূপ। নদীর তলদেশ থেকে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরে ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দুটি সুড়ঙ্গ করে এগিয়ে নেওয়া হয়েছে স্বপ্নের পথ। এটিকে বাস্তবে রূপ দিতে সুড়ঙ্গের ভেতর তৈরি হয়েছে দুটি টিউবও। নদীর বুক চিরে সেই দুটি টিউবের ভেতর করা হয়েছে চার লেন সড়ক। আসছে ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুলে দেবেন এই স্বপ্নের দরজা। এখন প্রায় দেড় হাজার শ্রমিকের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কেমন ভূমিকা রাখতে পারে এই টানেল- এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, 'অর্থনীতি সুদৃঢ় করতে দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই টানেল। টানেল ঘিরে মিরসরাই থেকে মেরিন ড্রাইভ চলে যাবে কক্সবাজার পর্যন্ত। তখন রাস্তার দুই ধারে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমও নদীর ওপারে সম্প্রসারিত করার সুযোগ তৈরি হবে।'

টানেলের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, 'নদী ভেদ করা দেশের প্রথম টানেল এটি; তাই চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। আছে নানা বাধাও। তার পরও আমরা সবকিছু শেষ করছি সুন্দরভাবে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। প্রকল্পের কাজ প্রায় ৯১ শতাংশ শেষ। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা শেষ করতে পারব শতভাগ কাজ।' টানেলে পুরকৌশল, বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক- তিন ধরনের কাজ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, এ তিন পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার পরই পরীক্ষামূলক যান চলাচল শুরু করতে চান তাঁরা। তিনি বলেন, 'সুড়ঙ্গ খনন, রাস্তা নির্মাণ, সংযোগ পথ তৈরির পুরকৌশলের কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলছে টানেলের ভেতরে বিকল্প পথ তৈরির কাজ। একটি টিউবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে বিকল্প পথে গাড়ি চালানো যায়, সেটি নিয়ে কাজ করছি আমরা। বাতি ও পাম্প স্থাপন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরির কাজও সমানতালে চলছে।' বাংলাদেশ সেতু কর্তৃৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে টানেল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)।

যেভাবে টানেলের যুগে বাংলাদেশ: 
চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে কর্ণফুলীতে টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। ২০১০ সালে প্রস্তাবটি প্রকল্প আকারে উপস্থাপন করা হয়। ২০১২ সালে ১২ কোটি টাকা খরচে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চীনা কোম্পানি সিসিসিসির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। দুই দেশের চুক্তি সই হয় ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ মোট ছয়টি প্রকল্পের ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেলের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। মাঝপথে দু'বছর করোনা হানা দিলেও নির্ধারিত সময়েই শেষ হচ্ছে টানেলের কাজ।

স্বপ্নের নাম 'ওয়ান সিটি টু টাউন': 
কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের চীনের সাংহাই শহরের মতো চট্টগ্রামেও নগর থাকবে একটি। তবে নদীর দু'তীরে থাকবে দুটি টাউন। এই মর্ম কথা বুকে নিয়ে টানেলের স্লোগান 'ওয়ান সিটি টু টাউন'। শুরুতে এই প্রকল্পের খরচ ধরা হয় ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। পরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা টাকা বেড়ে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার অর্থ সহায়তা দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা সহায়তা দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশকে ২ শতাংশ সুদহারে এই টাকা পরিশোধ করতে হবে ডলারে।

নির্মাণের শুরু থেকেই যুক্ত ছিল দেশি-বিদেশি ১২০০ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩০০ চীনা শ্রমিক। এখানে রাত-দিন নিয়মিত কাজ করছেন অন্তত ৮০০ জন। এর বাইরে প্রতিদিন ৩০০ শ্রমিক দৈনিক হিসেবে কাজ করেন। প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ করছেন অন্তত ৪০ সেতু প্রকৌশলী। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ২০ থেকে ২৫ জন।

টানেলের দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার: 
কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। তবে সংযোগ সড়কসহ টানেলের মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। নদীর নিচে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ মিটার ব্যাসের দুটি টিউব; এর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলে টিউব দুটি থাকলেও সংযোগ পথ আছে তিনটি। দুটি সংযোগ পথের কাজ শেষ হয়েছে আগেই। শেষের পথে তৃতীয়টির কাজও। এটি বিকল্প পথ হিসেবে প্রথম দুটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে। দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রথম সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৪ মিটার। দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩৪ মিটার। শেষটির দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৭৪ মিটার। প্রতিটির ব্যাস গড়ে সাড়ে চার মিটার। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকবে। আর আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। নদীর মাঝ পয়েন্টে এই গভীরতা প্রায় ১৫০ ফুট। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার। চট্টগ্রামে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে টানেলটি নদীর তলদেশ হয়ে চলে গেছে আনোয়ারার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থানে।

বছরে গাড়ি চলবে ৭৬ লাখ: 
টানেল দিয়ে বছরে প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি চলবে। চালুর তিন বছর পর ওই সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৬ লাখে। চালুর প্রথম বছরে চলাচল করা গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ হবে কনটেইনারবাহী ট্রেইলর, বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও কার্ভাডভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস, মিনিবাস ও মাইক্রোবাস এবং ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ছোট গাড়ি থাকবে। তবে সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এই ধারণার চেয়ে বেশি গাড়ি চলতে পারে টানেলে।

টানেলে গতি পাবে অর্থনীতি: 
টানেল ঘিরে সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি। এখন শিল্পকারখানা নগরকেন্দ্রিক থাকলেও টানেল চালু হলে নদীর ওপারেও তৈরি হবে সুযোগ। ওপারেও তখন সম্প্রসারিত হবে শিল্পকারখানা। চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, 'টানেলে যান চলাচল শুরু হলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী যানবাহনকে আর চট্টগ্রাম শহরে ঢুকতে হবে না। এতে চট্টগ্রাম শহরে যানবাহনের চাপ কমে যাবে। টানেলের সড়ক এক সময় এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হয়ে দাঁড়াবে।' তিনি জানান, কিছুদিন পর সমুদ্রের পাড়ে বে-টার্মিনাল চালু হবে। সেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মযজ্ঞ হবে। মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পুরোদমে চালু হলে লাখ লাখ মানুষ সেখানে থাকবে। এটিরও প্রভাব নগরীতে পড়বে। টানেলের অন্য প্রান্ত আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড, চীনা শিল্পাঞ্চল, মহেশখালীর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরসহ চট্টগ্রামে চলমান মেগা প্রকল্পগুলো চালু হলে বাড়বে জনসমাগম। সেসঙ্গে বাড়বে যানবাহনের চাপ। এ জন্য টানেলকে সামনে রেখে চট্টগ্রামের সড়ক নেটওয়ার্কেও বদল আনা হচ্ছে।

ডিসেম্বরের অপেক্ষা: 
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, অক্টোবরে টানেলের একটি সুড়ঙ্গ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে; অন্যটি চালু করা হবে নভেম্বরে। টানেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ডিসেম্বরে হবে। তবে প্রকল্প পরিচালক বলছেন, দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত বলতে পারব না আমরা। কারণ ট্রায়াল দিতে গেলে হয়তো নতুন নতুন জটিলতা বের হয়ে আসতে পারে। প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যে কাজ শেষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –