• সোমবার ১৩ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩০ ১৪৩১

  • || ০৪ জ্বিলকদ ১৪৪৫

করোনাকাল ও বঙ্গবন্ধু

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ৩১ অক্টোবর ২০২০  

মাসুমা সিদ্দিকা

আমরা অনেকে এখন করোনাকালীন সময়ে প্রায় ঘরবন্দি হয়ে থাকতে থাকতে একদম বিরক্ত হয়ে গেছি। আর থাকতে চাইনা ঘরে, অথচ আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কত অবলীলায়ই না তাঁর জীবনের বড় অংশ ঘরবন্দি থাকার চেয়ে  অনেক দুর্বিষহ কারা জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর পঞ্চান্ন বছরের মূল্যবান জীবনের সুদীর্ঘ বারো বছরই জেলে একাকী নিসঙ্গভাবে কাটিয়েছিলেন নির্জন কারাবাসে।  তাঁর জেল জীবনের সুদীর্ঘ ইতিহাস আমরা পাই তাঁর জীবন পর্যালোচনা করলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অটুট সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক। তাঁর কষ্ট সহ্য করবার অসম্ভব শক্তি, একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটানো সবই আমাদের আজকের জীবনের পাথেয় হতে পারে। 

আজকাল কোয়ারেন্টিন কথাটা প্রায়ই শোনা যায়। প্রথমেই দেখি কোয়ারেন্টিন বলতে আমরা কী বুঝি? কোয়ারেন্টিন হল সঙ্গরোধ। এটা কোনও  সংক্রামক ব্যাধি বা মহামারীয় বিস্তার প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে মানুষের মুক্তভাবে চলাচল এবং কখনও কোনও বিশেষ পণ্যের পরিবহনের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে বুঝায়। কোয়ারেন্টিন কথাটা খুব শক্ত আর এটা আমাদের জীবনে হুট করেই চলে আসেনি। এর পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৮৫১ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই সম্মেলনে  ইউরোপের বারটি দেশের প্রতিনিধি যোগ দেন। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল এশিয়া থেকে ইউরোপে যে কলেরা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছিল তা প্রতিহত করা। বাস্তবিক পক্ষে কলেরায় অনেক বেশি মানুষ মারা যাচ্ছিল এশিয়ায়। কিন্তু সেটা প্রতিহত করার জন্য নয়, বরং ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী  দেশগুলোতে কিভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য অটুট রেখে স্বাস্থ্য রক্ষা করা যায়, তা থেকেই এ সম্মেলন হয়। 

জেল জুলুম ও নিপীড়ন বঙ্গবন্ধুর জীবনে এক নিয়মিত রুটিনে পরিনত হয়েছিল। তিনি যে শুধু কারাবন্দীই ছিলেন তা নয়, প্রায় দুই বছর কাল তিনি গৃহবন্দীও ছিলেন, যখন উনার রাজনীতিও নিষিদ্ধ ছিল। তিনি যথাক্রমে ১৯৩৮, ১৯৪৮, ১৯৪৯, ১৯৫০, ১৯৫১, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৫, ১৯৬৬, ১৯৬৭, ১৯৬৮, ১৯৬৯ সর্বশেষ ১৯৭১ সালে জেলে যান। তিনি দুই বছর ১৯৬০ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কার্যত গৃহবন্দী ছিলেন এবং উনার রাজনীতিতেও নিষেধাজ্ঞা ছিল ঐ সময়ে। রাজনীতি ছিল যার রক্তে, রাজনীতি যার ছিল অস্থি-মজ্জায়, যিনি রাজনীতির জন্য সব ছেড়েছিলেন, তাঁর জন্য এই রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা মানা নিশ্চয়ই অনেক কঠিন ছিল। তিনি চাইলে হয়তোবা আত্মগোপনে থেকে অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই সেই অন্ধকার পথ না মাড়িয়ে অসীম সহনশীলতার সাথে শান্ত থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। এর ফলে কোন গোপন বা গেরিলা নেতা না হয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন জাতীয় নেতা। 

জাতির জনক জেলে থেকেছেন, জেল থেকে বাইরে বেরুতে পারেননি, বাইরের খোলা হাওয়ায় প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারেননি, পারেননি পরিবারের সাথে দেখা করতে, পারেননি বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করতে। আমাদের এখন নিজেদের ও পরিবারের জীবন রক্ষার জন্য বাইরে বেরুনো উচিত নয় বলে ঘরে বন্দি থাকছি যতটা পারি। আর বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন নিয়ে চিন্তা করেননি, দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, দেশের মুক্তির জন্য বছরের পর বছর জেলে কাটিয়েছেন একদম নিঃসঙ্গভাবে। 

বঙ্গবন্ধুর জীবনের ট্রাজেডি হলো ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়েছিল এবং এ দফায় তিনি একটানা ছয় মাসেরও বেশিকাল কারাভোগ করেছিলেন। তিনি জেলে ছিলেন নির্বাচনে জয়ের পরেও, যখন কিনা তাঁর রাষ্ট্র ক্ষমতায়  অংশীদার থাকবার কথা। ১৯৭০ এর নির্বাচনে জয়ী হয়েও তাঁকে পাকিস্তানের কারাগারে আটক থাকতে হয়েছে। এগুলো নিঃসন্দেহে যন্ত্রণাদায়ক ও হতাশাজনক ছিল।  অথচ আমরা কিনা তুচ্ছ ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ, বিনোদন, সিনেমা-থিয়েটার দেখা, খেলা, আড্ডাবাজি এসব নিয়ে হা-হুতাশ করছি।

বঙ্গবন্ধু বারাবার জেলে গিয়ে, বারবার কারাভোগ করে উদ্ভাসিত করে গেছেন একটা জাতি-সত্বাকে; রুপকার হয়েছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের - আজকের বাংলাদেশের। তার জেল জীবন কেমন ছিল এ বিষয়ে তিনি জানিয়েছেন, জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটেনাই, তাদের জেল কি জিনিস তা উপলব্ধি করা অসম্ভব। জনসাধারণ মনে করে জেল চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ভিতরে সমস্ত কয়েদি একসাথে থাকে, তা নয়। “জেলের ভিতরে অনেক ছোট ছোট জেল আছে।“ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ২৭) 

কারাগারের নির্মম অত্যাচারের কথা, সুখ-দুঃখের সব কথাই তাঁর 'কারাগারের রোজনামচা' পড়লে আমরা জানতে পারি। তাই খুব সহজেই আমরা অনুমান করতে পারি যে তাঁর কারাগার জীবন, তাঁর বন্দী জীবন কতটা কষ্টের, কতটা দুঃখের ছিল। অথচ আমাদের কোন অত্যাচার নেই, শুধুমাত্র কিছুদিনের জন্য নিজেদের  যতটা সম্ভব ঘরে আবদ্ধ রাখা নিজেদেরই স্বার্থে। এইতো সেদিন ২৫ মার্চ থেকে আমাদের ঘরে থাকার পালা শুরু হলো। আমাদের উপর আইনের কোন চোখ রাঙ্গানি নেই,  নেই কোন কড়া নির্দেশ। আমরা শুধুমাত্র কিছু নিয়ম-কানুন মেনে, মাস্ক পড়ে বাইরে যেতে পারি, দেখাও করতে পারি পরিচিত জন, আত্মীয়-স্বজনের সাথে। আমরা কেউ কেউ বেরিয়ে পড়ছি হুটহাট বাড়ি থেকে কখনওবা প্রয়োজনে, কখনো নানা বাহানায়; কখনওবা মন ভালো করতে। 

বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দী জীবনে থেকেও নিয়মিত তাঁর সহ-রাজনৈতিক নেতাদের, বন্ধুদের, আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন, তাঁদের ভাল মন্দের হিসাব রেখেছেন। আবার যার যেমন দরকার সেইভাবে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা ও দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। সবসময় তিনি অন্যের উপকার করে গেছেন, নিজের সম্পদ দিয়ে, নিজের জীবন দিয়ে। আমরাও এই কঠিন সময়ে যাদের করোনা হয়েছে তাদের কথা ভুলে না গিয়ে খোঁজ-খবর নিতে পারি,  তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করতে পারি।

রাতের  আঁধারের পরে যেমন সকালে সূর্য হাসে, যেমন করে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল হিসেবে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম, তেমনি আমাদের এই করোনাকাল অতিবাহিত হবে, খুব শীঘ্রই আবার সোনার দিন আসবে, আনন্দের বন্যা বইবেই। কেননা 'Hard time do not last, hard people last long' (কঠিন সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়না কিন্তু কঠিন মানুষেরাই দীর্ঘ দিন টিকে থাকেন)- প্রবাদটি তো মানুষের অভিজ্ঞতারই ফসল।

সূত্র: কালেরকণ্ঠ।

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –