• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে যা বলে ইসলাম 

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –

প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২  

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে এবং তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে। যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে ব্যক্তি অধিক আল্লাহকে ভয় করে।’ (সূরা হুজরাত: ১৩)
পৃথিবীতে যেমন বিভিন্ন জাতি রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন জাতির নিজস্ব ভাষাও রয়েছে। যেমন বাঙালির ভাষা বাংলা, ইংরেজদের ইংরেজি, আরব জাতির আরবি ভাষা। আমাদের ধর্মগ্রন্থ মহাপবিত্র আল কোরআন। মাতৃভাষার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। 

মহান আল্লাহ তায়ালা সব নবী-রাসূলকে স্ব-জাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। যাতে তারা স্বীয় জাতিকে দ্বীনের দাওয়াত স্পষ্টভাবে পৌঁছাতে পারেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, আমি রাসূলগণকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি, যাতে তাদের (দ্বীন) স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন। (সূরা ইবরাহিম: ৪)

কোরআনে মাজিদের এ আয়াত থেকে ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রতিভাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বীনের পথে দাওয়াত দানকারীদের জন্য মাতৃভাষায় পারদর্শিতা অর্জনের নির্দেশনাও পাওয়া যায়। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে আরও ইরশাদ হয়েছে, আপনি আপনার রবের পথে দাওয়াত দিন কৌশল ও উত্তম ভাষণের মাধ্যমে। (সূরা নাহল: ১২৫)

কোরআনের এসব বর্ণনা দ্বারা এ কথা বুঝতে বাকী থাকে না যে, স্বজাতিকে উত্তম ভাষণের মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়ার জন্য বিশুদ্ধ মাতৃভাষার ওপর পারদর্শিতা অর্জন অনিবার্য। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে’ বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী। ’ রাসূলের এ বাণী থেকে প্রমাণিত হয়; বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল মাতৃভাষায় কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করা রাসূল (সা.)-এর আদর্শ।
 
কোরআন আরবি ভাষায় আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়। পবিত্র কোরআন শরীফ আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হলেও অন্যান্য ভাষার ব্যাপারেও সম্মান দেখিয়েছে, এর কতগুলো কারণও রয়েছে। মাতৃভাষায় মানুষ সাধারণত যতটুকু কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি, আনন্দ, দুঃখ, আবেগ প্রকাশ করতে পারে, অন্য কোনো ভাষায় ততটুকু ভাব-ভাষা প্রকাশ করা মোটেও সম্ভব নয়। মাতৃভাষায় সব নীতিবাক্য যত সহজ এবং সরলভাবে স্মরণ ও করায়ত্ত থাকে অন্য ভাষায় ততটা সম্ভব হয় না। যদি কেউ, কোনো ব্যক্তিকে কোনো বিষয়ে বুঝাতে চায় তা হলে তার মাতৃভাষাতেই বুঝালে অতি দ্রুত বুঝতে সক্ষম হবে। 

মানুষ যাতে নবী রাসূলদের আদেশ নির্দেশ ও নিষেধ মেনে চলতে পারে এবং নবী রাসূলদের সব নীতিবাক্য যত সহজে বুঝতে পারে সেজন্য প্রত্যেক নবী রাসূলদের মহান আল্লাহপাক তাদের স্বজাতীয় ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা ইব্রাহীমের ৪নং আয়াতে ঘোষণা করেন, ‘আমি সব পয়গাম্বরকে তাদের স্বজাতীয় ভাষায় প্রেরণ করেছি। যাতে তাদেরকে সহজ ভাষায় বুঝাতে পারে। অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎ পথ প্রদর্শন করেন। তিনিই মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’

এ আয়াতের ব্যাখ্যা এমন হতে পারে যে, প্রথমত প্রত্যেক নবী রাসূলদের পরিবার, গোত্র বা বংশে এবং সমাজে তাওহীদের বাণী প্রচার করতে হতো। পরিবার-পরিজনকে তাদের ভাষায় এবং তাদের সামাজিকতায় ধর্মীয় জ্ঞান প্রচার করতে হয়।

নবী রাসূল বা পয়গাম্বরদের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তার বাণীসমূহ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন। তাই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবিতে কোরআন শরীফ, মুসা (আ.)-এর তাওরাত শরীফ-ইব্রানী ভাষায়, দাউদ (আ.)-এর জাবুর শরীফ-ইউনানী ভাষায়, ঈসা (আ.)-এর ইঞ্জিল শরীফ-সুরিয়ানী ভাষায় অবতীর্ণ হয়-(জজবায়ে মারফত পৃষ্ঠা ৪৫, হযরত মাওলানা আবদুর রশীদ ফরাজী)। 

আমাদের নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরবে জন্মগ্রহণ করেছেন। মহানবী (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবি। সঙ্গত কারণে আল্লাহ কোরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। যাতে করে আরব জাতিকে প্রথম পর্যায়ে ঈমান, তাওহীদ, তাকওয়া ও ইসলামের বিধানসমূহ সহজভাবে বোঝানো যায়। আর সাধারণ মানুষও আল্লাহর কথা সহজভাবে এবং গুরুত্বসহকারে বুঝতে পারে। মাতৃভাষার গুরুত্ব কতটা বেশি তা সূরা ইউসুফের ২নং আয়াত হতেই অনুধাবন করা যায়। এ ব্যাপারে আল্লাহ মহানবী (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমি কোরআনকে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করে সহজ করে দিয়েছি। যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পার।’ 

মহান আল্লাহ তাআলা আরবীয়দের কোরআন বোঝার জন্যই আরবি ভাষায় কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুধাবনের জন্য সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধি করা আমাদের একান্ত প্রয়োজন। 

তথাপি মহান আল্লাহর নিদর্শন হিসেবেও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নবান হওয়া ঈমানি কর্তব্য। কোরআন মজিদের বর্ণনা অনুযায়ী ভাষা বৈচিত্র মহান আল্লাহর অনুপম নিদর্শন। পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। ’ (সূরা রুম: ২২)

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রামরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন বরকত, সালাম, জব্বার, শফিক ও রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেক বীর সন্তানেরা। এভাবে মাতৃভাষার জন্য রক্তদান বা শাহাদত বরণের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দীপ্ত শপথে উৎসর্গকৃত তাজা রক্তের বদৌলতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে এবং রক্তে রঞ্জিত ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় ভূষিত হয়। আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা সৃষ্টিতে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনই প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। ভাষা আন্দোলনের এই গৌরবোজ্জ্বল রক্তিম ইতিহাস জাতিকে অনুপ্রাণিত করবে যুগ থেকে যুগান্তরে এটি আমাদের প্রত্যাশা। 

– কুড়িগ্রাম বার্তা নিউজ ডেস্ক –